নদীর জলে জীবন চলে: বাংলার পথিক

নিজস্ব প্রতিবেদক:নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রকাশিত: ৮:৫৫ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৭, ২০২২

ছবি: সারাদিন ডট নিউজ

সংসার জীবনের সাতকাহন আর অফিসের নানা কাজের চাপে নাজেহাল জীবনটাকে কিছুটা সস্তি দিতে ঘুরতে বের হবো। কিন্তু যাবো কই পাহাড়? সমুদ্র? নাকি চা বাগান? এমনই এক ভাবনা নিয়ে আমার অফিস কলিগ বড় ভাই পার্থ সারথি সরকারকে সাথে নিয়ে আলাপের ছলে বনানীর সৈনিক ক্লাব থেকে পায়ে হেটে ক্যান্টনমেন্ট ক্রস করছি। হটাত মনে হলো ঝাল মুড়ি খাই, হয়তো কোন সমাধান পাবো, মানে কোথায় যাবো সেটা নির্ধারণ করতে পারবো।

কাফরুল ডিজিএফআই-এর অফিসের পাশের রাস্তায় এখন যে বিখ্যাত মজিদ মিয়ার মুড়ির দোকান তখন ছিলো ছোট্ট একটি হাতে ঠেলা কাচের ভ্যান এর উপরে। ছোট বড় মাঝ বয়সী অনেক মানুষের ভিড়। আমি আর পার্থ দাদা একপাশে দাঁড়িয়ে মুড়ি মাখা অর্ডার করতে যাবো এমন সময় মজিদ ভাই জানালেন “মামা আজ আর হবে না , পুরো গামলা বুক!” আমি কিছুটা আশাহত তখন পাশে থেকে একজন বললেন “ভাই আজকে এই দোকানের সব মুড়ি মাখা ফ্রি! আপনি আমাদের সাথে একসাথে এক গামলায় খাবেন। কোন ব্যাপার না বসেন। আমি আর পার্থ ভাই অবাক! আরো অবাক হলাম অনেকেই এসে তার সাথে সেলফি তুলছে, সবাই খুব উচ্ছ্বসিত।

কিছুক্ষণের জন্য আমি আর পার্থ দা একপাশে বেঞ্চে বসে তাদের আনন্দ দেখছিলাম। সবাই কত উল্লসিত, আনন্দে উদ্বেলিত! আমি লোকটার নাম জেনে সার্চ দিলাম ফেইসবুকে। দেখি তিনি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আগে থেকেই আছেন। এরপর আমি খেয়াল করলাম তারা জেনো কোথায় যাবার প্লান করছে। যদ্দুর বুঝলাম বরিশালের কোন এক অঞ্চলে ঘোরার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই।

সেদিন আর কথা হলো না। একদিন আমি তাদের ফেইসবুক গ্রুপে যুক্ত হলাম। তিনি ম্যাসেঞ্জারে আমাকে খুদে বার্তা পাঠালেন ” সবুজ কতোটা সবুজ হতে পারে দেখতে চান? তাহলে আগামী বৃহস্পতিবার রাতে চলে আসুন সদরঘাট সুরভী ৭ লঞ্চ এ।

ঠিক রাত ৮ টায়।” আমি রীতিমত অবাকই না, উত্তেজনা ও আগ্রহে জেনো ঠিকমতো অফিস করতে পারছিনা। একটু পর পর বিভিন্নজন বিভিন্ন ম্যাসেজ দিচ্ছে। আর আমি ভাবছি কি হতে চলেছে। বৃহস্পতিবার সকালেই বাসা থেকে একেবারে তৈরি হয়েই অফিসে এলাম। পার্থ ভাই গেলেন না। আমি সন্ধ্যাবেলা সরাসরি সিএনজি নিয়ে চলে গেলাম সদরঘাট। ঠিক সন্ধ্যা ৭ টা ৫০ মিনিটে সদরঘাট পৌঁছে সুরভী লঞ্চ খুঁজলাম কিছুক্ষণ। এরপর লঞ্চে উঠে দোতলার শেষ মাথায় আবিষ্কার করলাম বিশাল এক দলের। প্রায় পঞ্চাশ জনের মতো বিভিন্ন বয়সের মানুষ গল্পে মশগুল।

Nagad

রাত সাড়ে আট টা। সদরঘাটের হট্টগোল বাড়ছে। একে একে ফাঁকা হচ্ছে লঞ্চঘাট। আমি ছাদে গিয়ে আকাশ দেখলাম কোন মেঘ নেই তো? একবার শহরের ঝকমকে আলোর দিকে ভালো করে তাকালাম। ঝলমলে নানা আলোর তিলোত্তমা এই শহর ছেড়ে আমি যাচ্ছি কোথাও। জেনোবিশ্বাস হচ্ছিলো না। একটা সময় তীব্র হুইসেল বাজিয়ে ইঞ্জিনের শব্দ বেড়ে গেলো। বুঝলাম সত্যিই আমি ফাইনালি এই শহর ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি। আমি ছাদ থেকে নেমে সোজা লঞ্চ এর তৃতীয় তলার সামনে চলে গেলাম। আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো পোস্তগোলা ব্রিজ। আমি বাতাসে নিঃশ্বাস নিলাম। সমস্ত অবসাদ পেছনে ফেলে নদীর বুকে চাঁদকে সাথি করে সব কৃত্রিম আলোকে নিভে গেলো আর আমি যাচ্ছি, দূরে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি।

প্রায় ঘণ্টা খানেক আমি স্বপ্নময় জগতে বিচরণ করে হটাত একজনের ডাক পেলাম। মানুষটা আমাকে বললেন “ভাই, রাতে কি খাবেন? ডালের চড়চড়ি আর নদীর মাছ দিতে বলি?” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। বললাম ভাই আপনি যা খাওয়াবেন, আর দশ জনে যা খাবে আমিও তাই খাব।” এতটুকু শুনে তিনি ওকে ভাই, সাড়ে দশটায় আমরা খেতে যাবো বলে চলে গেলেন। আমি আবার অন্ধকারে আপন মনে দূর নদীতে চেয়ে থাকলাম। লঞ্চে মানুষজনের নানান কথা, কিছু মোবাইলের গান, নদীর ঢেউয়ের

আছড়ে পড়া শব্দ আর চোখের সামনে বিশাল আকাশ সব মিলে আসলে আমি তখন কোথায় ছিলাম, কে জানে?

একসময় লঞ্চ মেঘনায় নেমে গেলো। নদীর দু পাশে ছোট বড় জলযানের ভীর কমে গেলো। মনে হলো পুরা নদীতে শুধুমাত্র আমরাই। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আমি বাতাসে আর দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। তখন লঞ্চের তিন তলা থেকে দোতালার ডেকে আসলাম। দেখলাম গ্রুপের একদল খেতে চলে গেছে। ব্যাগ মালামাল নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে নারী ও শিশুদের আগে খেতে পাঠানো হয়েছে। এরপর সব পুরুষদের সিরিয়াল। আমি লঞ্চের ডেকের একপাশে বিছানা করে ফেললাম। সবার ঢালাও বিছানা।

সেখানে শুয়ে বসে সবাই সেই মজা করছে আর তাদের নানান দর্শনীয় স্থানের গল্প আর আলোচনা দেখে বুঝলাম, সবাই অনেক ঘোরাঘুরি করে। ধীরে ধীরে টিমের সকল পুরুষ সদস্যদের সাথে পরিচয় ঘটলো।তারই মধ্যে খাবারের ডাক এসে গেলো। সবাই শিরি বেয়ে নিচে নেমে ইঞ্জিনের পাশে ক্যান্টিনে গেলাম। খুবই ছিমছাম আয়োজন।

নদীর পোমা মাছ, ডাল আর ভাত এইতো। যারা মাছ খেলোনা তারা মুরগী খেলো। এরপর চা দিয়ে চিত্তকে তৃপ্ত করে দোতলা ডেকে বিছানায় গিয়ে বসলাম। কেউ বই পড়ছে, কেউ লুডু, কেউবা বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি কিছুটা সময় বিছানায় শুয়ে ছিলাম।

এরপর ভাবলাম মাঝ রাতের চাঁদের আলোয় নদীটা দেখে আসি। তৃতীয় তলায় ভিড় অনেকটা কমে গেছে। কেবিনের লোকগুলো ঘুমিয়ে গেছে। আমি বারান্দায় একটা ফাকা চেয়ার পেয়ে বসে পড়লাম। বাতাস এখন মৃদুমন্দ। দৃষ্টিতে যতো দুর দেখছি জেনো তৃপ্তি মেটেনা। একটা সময় এলো যখন আমাদের লঞ্চ এর পাশ দিয়ে অন্য আরো লঞ্চ ক্রস করছে। সুন্দরবন, পারাবত,রাজহংস,মায়ামি সহ আরো কত নাম। জুলাই মাস হলেও তেমন ঝড় বা বৃষ্টি ছিলোনা সেদিন। আমি তৃতীয় তলার ছোট্ট ক্যান্টিন থেকে কফি নিলাম। রাত বেশ গভীর হয়েছে। ভোরবেলা বরিশাল বন্দরে ভিড়বে লঞ্চ। আমাদের সকালে লঞ্চেই ডিম খিচুড়ির আয়োজন করা হয়েছে। তাই সকালে তাড়াহুড়ো নেই।

আমি পুরো লঞ্চে ছোট বাচ্চাদের মতো ঘোরা শুরু করলাম। কখনো নিচতলায় গিয়ে টেলিভিশন দেখছি, কখনো দোতলার সামনে গিয়ে বাতাস খাচ্ছি। কখনো আবার তৃতীয় তলায় চেয়ারে বসে থাকছি। কখনো ইঞ্জিন রুমের কাছে গিয়ে দাড়িয়ে চা খাচ্ছি। কোন কিছুতেই আমার কোন ক্লান্তি নেই। লঞ্চের মানুষগুলো কতো সুন্দরভাবে ঘুমিয়ে আছে। কেউ একা জেগে আছে। কিছু সময় আমাদের দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছি দুজন দুজনকে। এরপর আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে চলে এলাম আমার দোতালার বিছানায়। শেষ রাতে নদী কিছুটা উত্তাল। আমাদের পুরো লঞ্চ রীতিমতো দুলছে। যা কিছু অভিজ্ঞতা হচ্ছে তাতে আমার মন্দ লাগছে না। আমি পরম আনন্দ উপভোগ করছি। একটা সময় মনে হলো ঘুমাতে হবে। আমি ঘুমিয়ে গেলাম। ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছি তার উত্তর মিললো যখন সকালে উঠে দেখি কেবল আমার বিছানাই অবশিষ্ট আছে দেখে। লঞ্চ ততক্ষণে ঘাটে ভিড়ে গেছে। একদল টোকাই পানির প্লাস্টিক বোতল নিতে উঠে গেছে। সাথে চিড়া মুড়ি, কলা পাউরুটি, সিদ্ধ ডিম, ফলমুলসহ বেশ কিছু হকার।

সূর্য ওঠার সাথে সাথে খুলে দেয়া হলো জানালায় লাগানো বিশেষ ত্রিপল। নদীর নাম কীর্তনখোলা। আহা কি সুন্দর বয়ে যাওয়া নদী, পুব আকাশে সূর্য তাকে আরো মায়াবী করে সাজিয়েছে। আহা ঘুম ঘুম চোখে আমি আবারো কৌতূহলী দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছি। এর কিছুক্ষণ বাদেই শুরু হলো বৃষ্টি। আমি নদীতে তুফান বা বৃষ্টি কোনটাই দেখিনি আগে। ঘটনাগুলো কি যে ভালো লাগছিলো বলে বোঝানো কঠিন। সকালে আমি নিচে গিয়ে চা খেলাম।

এরপর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিলাম দোতালায় কেবিন যেখানে সেখানের বাথরুমে। তারপর শেষ বারের মতো লঞ্চের তৃতীয় তলার ছাদে গেলাম। সেখানে সারারাত ধরে হুইল চালানো লঞ্চের কাপ্তানকে স্বাগত জানিয়ে ধন্যবাদ দিলাম। তিনি আমার সাথে হাত মিলিয়ে বললেন ” আমাদের নদীর জলে জীবন চলে”। আমি আমার সমস্ত উচ্ছ্বাস চেপে রেখে তার সাথে বুক মেলালাম। জীবন সম্পদ কি অসাধারণ উক্তি! সেই কথা ভাবতে ভাবতে খাবারের ডাক আসলো। ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নেমে খেলাম। আর তারপর সবাই মিলে নামলাম বরিশালে।

লঞ্চঘাটের আশেপাশে ঘুরে নদী ও নদীর সাথে সম্পৃক্ত নানা রকম জীবিকার সন্ধান পেলাম। সে সকল মানুষগুলোর ব্যস্ততা আর পণ্যের বেচাকেনা দেখতে দেখতে আমাদের জন্য রিজার্ভ করা বাস আসলো। আমি জানতে পারলাম এই বাসের ছাদে উঠা যায়। কোন দেরি করলাম না। মাথায় গামছা বেধে সরাসরি ব্যাগ নিয়ে ছাদে। মূহুর্তে আরো কিছু সমমনা মানুষ যুক্ত হলেন।

আমাদের গন্তব্য নেছারাবাদ মাদ্রাসার সামনে সন্ধ্যা নদীর ঘাটে যাওয়া। বাস ছেড়ে দিলো। বরিশাল শহর ছেড়ে আমরা পৌঁছলাম ছোট্ট সরু এক রাস্তায়। কি দারুণ সবুজে আচ্ছাদিত পথ। বাতাসে প্রকৃতির সুঘ্রাণ। গুঠিয়া মসজিদ পাড়ি দিয়ে আমরা যাচ্ছি হটাত আমাদের এক বড়ভাই আমড়া গাছে আমড়া দেখে সেই মাত্রায় উচ্ছ্বসিত। কয়েকটি পেড়েও ফেললেন। এর কিছুক্ষণ পর এলো চালতা গাছ। এবার চালতাও পাড়া হলো। এই গাছগুলো রাস্তার পাশে লাগানো কোন মালিকানা গাছ না, সরকারি। আর এই অঞ্চলে প্রায় প্রতিটি রাস্তা আমড়া চালতা কাঠ বাদাম গাছ খুবই কমন। আমাদের বাস ঘণ্টা দেড়েক সময় নিয়ে পৌঁছে দিল নেছারাবাদ।

সেখানে আগে থেকে ঠিক করে রাখা ট্রলারে সবাই চড়ে বসলাম। তারপর সন্ধ্যা নদী থেকে ট্রলার রওনা দিলো একটা বড় খাল দিয়ে। গন্তব্য আটঘর কুড়িয়ানা। এরপর ভিমরুলি। আমার সাথে এক বড়ভাই বসলেন। তিনি এর আগেও এইখানে দুবার এসেছেন। ট্রলার এগিয়ে চলেছে খালের ভিতর দিয়ে। সবুজ প্রকৃতি আরো সবুজ হচ্ছে। নারিকেল সুপারি খেজুর গাছে দূরে উকিজুকি দিচ্ছে।

খালের দুধারে হিজল তমাল জারুল চম্বল মেহগনি গাছের সারি। আমি প্রথম বারের মতো খালের পানি ছুঁয়ে দেখলাম। ঠাণ্ডা কিন্তু ঘোলা। খানিক বাদে ছোট ছোট নৌকা চোখে পড়লো। একেক নৌকায় একেক রকম পণ্য। একটু বড় নৌকায় নার্সারির গাছ বোঝাই করা। আর ছোট নৌকাতে কোনটিতে পেয়ারা,আমড়া আবার কোনটিতে সবজি,গাব,জাম্বুরা। সবাই কোথায় জেনো যাচ্ছে। ঘণ্টা খানেক পড় আমাদের ট্রলার আরো সরু খালে প্রবেশ করলো। বলতে গেলে দুপাশ থেকে কেউ চাইলে লাফ দিয়ে ট্রলারে উঠতে পারবে। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।

একে তো খালটি সরু আর দুপাশে অগণিত পেয়ারা বাগান। যতো এগিয়ে যাচ্ছি এর কোন কমতি নেই বরং বাড়ছেই। একটা সময় বুঝলাম আমরা পুরো দুস্তর একটা পেয়ারা বাগানে ঢুকে গেছি। আমাদের ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সামনের ট্রলারে যাতে ধাক্কা না লাগে। সবাই জোয়ারে ভাসছে। আমি বারেবারে ওই মানুষটার কথা মনে করছিলাম ” সবুজ কতোটা সবুজ হতে পারে।” আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো নদীর জলের জীবন ধারণ দেখছিলাম। আর ভাবছিলাম শহরে এসিতে বসে অফিসের প্যারা নিতে হাঁপিয়ে যাই আর এই মানুষগুলো কিভাবে কত পরিশ্রম করে পানির সাথে বেচে আছে। প্রবহমান নদী এদের সবকিছু।

আমাদের এই যাত্রায় একটাই বিড়ম্বনা ছিল বেলা বাড়ার সাথে সাথে গরম আর রোদ। আমরা পথ চলতে চলতে চলে এলাম ভিমরুলি। ট্রলার একটি স্কুল ঘাটে আমাদের নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে আমরা ব্রিজে উঠলাম। কি সুন্দর আর মনোরম সেই দৃশ্য। খালের ভিতর অসংখ্য ছোট বড় নৌকা। খালের পাশে সাজানো মাচা করা নাড়ার ছাউনি

দেয়া ঘর। সেই ঘরে চলছে বিভিন্ন পণ্যের দরদাম। ভিমরুলি ভাসমান বাজারকে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সর্ব বৃহৎ ফ্লোটিং মার্কেট। এখানে এসে জানতে পারলাম ভাসমান এই বাজারের বয়স প্রায় ৪০০ বছর। এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র এটি যার মূল উপাদান হলো পেয়ারা, ও কাচা কলা। এছাড়া সারা মৌসুমে কৃষকের ঘরে, বাগ বাগিচায় যে ফসলই ফলে চলে আসে এই বাজারে। এই বাজারের মিষ্টি ভুবন বিখ্যাত। ২০১০ সাল থেকে এই ফ্লোটিং মার্কেট বিদেশী পর্যটকদের নজরে আসে। সেই থেকে এখানে পর্যটকদের জন্য নানান রকম দেশীয় পণ্য ও খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে।

সবকিছু দেখে সন্তুষ্ট না হয়ে আপনার উপায় থাকবেনা। এই ভ্রমণে আমাদের ট্রলারে তোলা হলো আখ, পেয়ারা,চালতা,আমড়া,সুপারি,তাল,বিলাতি গাব,সফেদা,তেঁতুলসহ আরো নানা পণ্য। এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথটা আরো সুন্দর। আমাদের এই সবুজের অভয়ারণ্যে দৃষ্টিকে আরো আচ্ছাদিত করে সরু খাল থেকে আবার একটি বড় খালে নেয়া হলো। এরপর সবাইকে দেয়া হলো লাইফ জ্যাকেট। সে কি আনন্দ। সবাই পানিতে ঝাপাঝাপি শুরু করলাম। আহা মনে হলো বেহেস্ত।সেই সুখে যুক্ত হলো দেশি মাছ, হাসের মাংস,দেশী মুরগী আর গরম চালের ভাত। কেউ পানিতে কেউ ট্রলারে কেউ মাটিতে যার যেভাবে ভালো লাগে খেলাম পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে। এরপর জুম্মার নামাজ আদায়ে নেয়া হলো গ্রামের এক মসজিদে।

সেখানে সময় কাটিয়ে আমাদের পুনরায় চাখারে নেয়ার পরিকল্পনা হলো। আমরা একটা বড় খালের পাশে নেমে পূর্বের নির্ধারিত বাসে উঠলাম। সবাই তখন বেশ ক্লান্ত কিন্তু গল্প থেমে নেই। আমি আর আমার মতো আরো কয়জন বাসের ছাদই দখল করলাম। এরপর শুরু হলো মূল এডভেঞ্চার।

এই গাছের ডালের বারি শেষ না হতেই ও গাছের ডাল। আর তার তার উপরে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ লাইন। তবুও ছাদেই থেকে গেলাম। বাস এসে যখন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এর বাড়িতে থামল এরপর আমরা সবাই নেমে গেলাম। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এর বাড়ি ও যাদুঘর পরিদর্শন শেষে আমাদের বাস এলো গুঠিয়ায়।

এখানে সেই বিখ্যাত গুঠিয়া মসজিদ। মূলত এর আসল নাম বাইতুল আমান জামে মসজিদ। ১৪ একর জমির উপর নির্মিত মসজিদটি প্রায় ২০ হাজার মুসল্লির একসাথে ঈদের নামায আদায়ের ব্যবস্থা করেছে। এই মসজিদের সামনে রয়েছে একটা বড় পুকুর। সেখানে অনেকেই ওযু ও গোসল করে। আমরা দুর্গা সাগর গোসল করবো বলে আর এই পুকুরে নামলাম না।

বিকালে প্রায় সূর্যের অস্ত যাওয়ার আগ মুহূর্তে আমরা নামলাম দূর্গাসাগর দিঘিতে। ১৭৮০ সালে তৎকালীন রাজা শিব নারায়ণ তার স্ত্রী দূর্গামাতার নামে এই দিঘী খনন করেন। আমার মন চাইছিলো পুরা দিঘীর চারিপাশের রাস্তাটা একবার প্রদক্ষিণ করি। কিন্তু সময়ের স্বল্পতায় আর শেষ বেলার ক্লান্তিকে দিঘীর জলেই বিসর্জন দিলাম।

সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। সন্ধ্যায় আমরা শহরে ফিরে এলাম। সবাই নামলাম বিবির পুকুরে। শহরের ভিতরে বিশাল এক পুকুর।

একজন ভাই আমাদের বরিশালের বিখ্যাত দই চিড়া খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। আমি শেষ বেলায় এই আতিথেয়তায় চরম মুগ্ধ হলাম। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা আর গল্প

করে শুক্রবার রাতেই আবার বরিশাল সদরঘাটে পৌঁছলাম। এরপর ক্লান্তি ভুলে যেতে সিঙ্গেল একটা কেবিন নিয়ে নিলাম। রাতে শেষ বারের মতো নদীর মাছ, ডাল খেয়ে আনন্দ চিত্তে অসাধারণ কিছু সুখের অনুভব নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

ভোর ৫ টায় ঢাকা সদরঘাট এলাম। ফিরে এলাম শহরে। কিন্তু কিছুতেই সবুজ বাগান, সরল খালের বয়ে চলা, আর মানুষগুলোকে ভুলতে পারলাম না। আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা ছিলো না সেই মানুষটার প্রতি যে আমাকে এই সুখের অনুভূতিটুকু উপহার দিয়েছেন। সেই মাহমুদ হাসান খান ভাই। যিনি ভ্রমণ গ্রুপে ওস্তাদ মাহমুদ ভাই বা হ্যামিলনের বাশিওয়ালা নামে পরিচিত। আজ ফেইসবুকে যেসকল কমিউনিটি ট্যুরিজমের বিস্তৃতি তার জনক ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আর আমাকে করে গেছেন বাংলার পথিক। মাহমুদ ভাই বলেছিলেন ” প্রবহমান জলে শ্যাওলা জমে না” তাই নদীর জলে যাদের জীবন চলে তাদের মনে কোন শ্যাওলা নেই। ভ্রমণ এই গল্পটি আমার সেই মহান পথ প্রদর্শকের প্রতি উৎসর্গ করলাম।

সারাদিন. ১৭ নভেম্বর. আরএ