থামছে না সুন্দরবনের খালে বিষ প্রয়োগ

‘৫২ বছর ধরে জঙ্গল করি। কিন্তু আগে এসব বিষ দিয়ে মাছ ধরার চল ছিল না। পাঁচ বছরের মতো হলো বনে বিষ ঢুকেছে। এ জন্য আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না। এখন ভাবতিছি ছাওয়ালগের কথা। আগের মতো সুন্দরবনে আর মাছও পাওয়া যায় না। আমার জীবন তো কাইটে গেল, ছাওয়ালগের কী হবি?’এভাবে কথাগুলি বলছিলেন সুন্দরবনের জেলে ময়জুদ্দিন মোড়ল।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন ‘সুন্দরবনের খালের পানিতে এখন আর পানি পড়া না দিলে মাছ পড়তেও চায় না।’ এই পানি পড়ার মানে জানতে চাইলে ওই জেলে বললেন, বনের মধ্যে খালের এক প্রান্তে জাল পেতে আরেক প্রান্তে পানি পড়া ছিটিয়ে দিলে মাছ সব দুর্বল হয়ে জালের মধ্যে চলে আসে।

অর্থাৎ বিষ ছিটিয়ে মাছ শিকারের বিষয়টিকে তিনি পানি পড়ার সঙ্গে তুলনা করলেন। জলাশয়ে যদি এসব বিষ পড়ে, তাহলে সুন্দরবন আর থাকবে না।

বাংলাদেশের অন্যতম কুমির বিশেষজ্ঞ এবং সুন্দরবনের করমজলের সাবেক ওসি আব্দুর রব বলেন ‘ বিষ দিয়ে শিকারের ফলে সুন্দরবনের নদী ও খাল মাছ শূন্য হয়ে পড়ছে। বিষের কারণে মাছের সঙ্গে সঙ্গে মারা যাচ্ছে অন্যান্য জলজ প্রাণীও। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে এ বনের জলজ সম্পদ। অনিয়ন্ত্রিত বিষের দাপটে জলজ সম্পদের প্রজনন ও উৎপাদন বিঘিœত হচ্ছে। সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় জেলেরা বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করায় মানুষ খাচ্ছে বিষাক্ত মাছ। বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।

মোংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি আহসান হাবিব হাসান বলেন, “সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরায় শুধু এক প্রকারের মাছের ক্ষতি হচ্ছে না, অন্য সব প্রজাতির মাছই ধ্বংস হচ্ছে। পাশাপাশি এর সঙ্গে বন ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বিষ দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতা শূন্যের কোঠায় আনতে কঠোর অভিযানের দরকার। একই সঙ্গে অসাধু ওইসব জেলেদের মহাজন ও সিন্ডিকেট চিহ্নিতকরণও প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, বিষাক্ত পানির মাছ খেলে মানুষের পেটের পীড়াসহ কিডনি ও লিভারে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ বিষয়টি স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিষ মিশ্রিত মাছ না খাওয়ার জন্য জনসাধারণকে সজাগ থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

Nagad

সুন্দরবন ঘেঁষা মোংলার জয়মনি গ্রামের চিকিৎসক ও গবেষক এমদাদুল হক টুকু বলেন, “সুন্দরবনের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে জলাভূমি। জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে ৪৫০ নদ-নদী। আর এই নদ-নদীতে রয়েছে ৪৭৫টি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার মাছ বিষপ্রয়োগে মারা হচ্ছে। এতে শয়ে শয়ে মাছের প্রজাতি ধ্বংসের পাশাপাশি মৎস্য প্রজনন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয়রা জানান, সুন্দরবনের ঢাংমারী, মরাপশুর, জোংড়া, ঝাপসি, ভদ্রা, নীল কমল, হরিণ টানা, কোকিলমুনী, হারবাড়িয়াসহ আশপাশ এলাকায় বন সংলগ্ন স্থানীয় অসাধু কিছু জেলে নামধারী মৎস্য দস্যু বিষ দিয়ে মাছ ধরছে। বেশি মুনাফার আশায় সুন্দরবনের বিভিন্ন নিষিদ্ধ খালেও বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। বিষাক্ত পানি সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল থেকে ভাটার সময় নদীতে নেমে আসে। এ কারণে মাছ মরে যাওয়ায় এখন নদীতে আর ছোটো-বড়ো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বিষ প্রয়োগের ফলে জীববৈচিত্রসহ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার পরও সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের ধ্বংসযজ্ঞ থেমে নেই। বেশি মুনাফার আশায় সুন্দরবনের বিভিন্ন নিষিদ্ধ খালেও বিষ দিয়ে মাছ শিকার করেন জেলেরা।

সবশেষ গত ১৫ জানুয়ারি সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের অধীনে কোবাদক স্টেশনের কালিরখাল এলাকা থেকে বিষ দিয়ে মাছ শিকার অপরাধে দুই জেলেকে আটক করেছেন বন বিভাগ। এ সময় তাদের কাছ থেকে নৌকাসহ তিনটি বিষের বোতল ও জাল উদ্ধার করা হয়। আটক জেলেরা হলেন, কয়রা উপজেলার ঘড়িলাল গ্রামের লোকমান খানের ছেলে রইজ উদ্দীন খান (৪৫) ও লুৎফর মোল্যার ছেলে মাছুম মোল্যা (৩৫)। তাদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে প্রশাসনের অভিযানে ২৯৩টি নৌকা ও সুন্দরবন থেকে বিষ দিয়ে ধরা ৩ হাজার ৬৬০ কেজি মাছ জব্দ করা হয়েছে। ২১৬টি মামলা ও ২২৪ জন জেলেকে আটক করা হয়।

সুন্দরবনের পাতকোস্টা টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শ্যামা প্রসাদ রায় জানিয়েছেন, জেলেদের দাদনের ফাঁদে ফেলে কিছু অসাধু মানুষ বিষ দিয়ে মাছ শিকারে উৎসাহিত করে। আবার কেউ কেউ জেলেদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে সংরক্ষিত বনের খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার ও পাচারে সুযোগ করে দেয়। বিষ দিয়ে মাছ ধরায় ৪০ জনের মতো জেলের সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতিপত্র বাতিল করা হয়েছে।

সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, অভিযান চালিয়ে অসাধু ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তাঁরা দ্রুত জামিনে এসে আবার একই কাজ করেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিষ দিয়ে শিকার করা মাছ শনাক্ত করার মেশিন তাঁদের কাছে নেই। তাই প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করা যায় না।