লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়ক যেন মরণফাঁদ, গত ১০ দিনে ৫ জনের মৃত্যু

লালমনিরহাট প্রতিনিধি:লালমনিরহাট প্রতিনিধি:
প্রকাশিত: ৬:০৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ৩, ২০২৪

লালমনিরহাট-বুড়িমারী আন্তর্জাতিক মহাসড়ক যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। এই সড়কে যারা চলাচল করেন তারা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে চলেন। মহাসড়কটির প্রতিটি পদে পদে ক্রুটি পূর্ণ কানা বাঁক, রেলক্রস, আঁকাবাঁকা। পুলিশ পোটকল নিয়ে চলা মন্ত্রীও এই সড়কে দুর্ঘটনায় পড়ে অল্পতে প্রাণ বেঁচে যায়। গত ১০ দিনে ৫ জনের মৃত্যু ও ৫০ জন আহত হয়েছে। জেলার ৫টি উপজেলা সদর ও দেশের তৃতীয় বৃহত্তর চতুর্থ দেশীয় আন্তর্জাতিক স্থলবন্দরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মহাসড়ক।

জানা গেছে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি হতে পহেলা মার্চ ১০ দিনে লালমনিরহাট বুড়িমারী মহাসড়কে ট্রাক, বাস ও কার্ভাটভ্যানের ধাক্কায় প্রাণ গেছে কমপক্ষে ৫ জনের, আহত হয়েছে কমপক্ষে ৫০ জন। ১৯ ফেব্রুয়ারি কাকিনায় একটি নৈশকোচ উল্টে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়, এতে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তবে আহত হয়েছে কমপক্ষে ৩৫ জন। একই দিনে জেলার বুড়িমারী আন্তর্জাতিক সড়কের পাটগ্রামে ট্রাকের ধাক্কায় আমিনুর রহমান (৩০) ও সহিদার রহমান (৫০) নামের দুই পথচারী নিহত হয়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আব্দুল্লাহ (১২) নামের এক মাদরাসা শিক্ষার্থী লালমনিরহাট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের বিনিময় ফিলিংস স্টেশনের সামনে ২২ চাকার লরির চাকায় পৃষ্ঠ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যায়। হাড়িভাঙার তালিমুল ইনসান কওমি হাফিজিয়া মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি আদিতমারী উপজেলার সাপ্টীবাড়িতে বুগিমারী সড়কে ট্রাকের ধাক্কায় ফরিদুল ইসলাম (২৮) নামে এক ট্রলিচালক নিহত হন।

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ওয়াবদা বাজার সড়কে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় অটোরিকশার যাত্রী ৫ কলেজ শিক্ষার্থী আহত হয়। তাদের একজন সোহেল অনার্স পরীক্ষার্থী মারা যান। এছাড়াও কয়েক বছর আগে এই মহাসড়কের রেলওয়ে ক্রসিংয়ে ট্রেনের ইঞ্জিনের ধাক্কায় প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মোতাহার হোসেন এমপির গাড়ি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। প্রাণে রক্ষায় পেয়ে যান মন্ত্রী। কয়েক বছর পাটগ্রামের বুড়িমারীতে ট্রাকের চাপায় দুই পুলিশ সদস্য কর্তব্যরত অবস্থায় মারা যায়।

লালমনিরহাট-বুড়িমারী আন্তর্জাতিক মহাসড়কটি মরণ ফাঁদ। যার প্রধান কারণ রাস্তাটি দ্রুতগতির যানবাহন চলাচলে সম্পূর্ণ ক্রুটিপূর্ণ। এই রাস্তাটি এক সময় ছিল গরুর গাড়ি চালানোর রাস্তা। সেটিকে ১৯৮৮ সালে সড়ক ও জনপদের রাস্তা ঘোষণা করা হয়। রাস্তাটি নির্মাণের সময় দ্রুতগতির যানবাহন চলাচলে গতি জড়তা, প্রতিটি মোড় প্রায় ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল, ঘরবাড়ি গাছপালা থাকায় একপাশ হতে অন্য পাশে দেখার কোনো উপায় নেই।

লালমনিরহাট-পাটগ্রাম রেল লাইনটি আন্তর্জাতিক মহাসড়কটির উপর দিয়ে ১৪ বার ক্রস করেছে। একটিও রেলক্রসিংয়ে রেলকর্মী নেই। রাস্তায় ৩৫টি জায়গায় এমনভাবে রাস্তাটি চলে গেছে সেখানে সৃষ্টি হয় গতি জড়তা। জেলার প্রধান এই সড়কটির ২০/২৫টি জায়গায় গ্রামীণ অঞ্চলিক সড়ক এসে সংযোগ হয়েছে। ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলের প্রতিটি মোড় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বিশাল আকারের লরিগুলো এখানে ঘুরতে গিয়ে সমস্যায় পরে।

তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোড় শহরের মিশনমোড়, সাপ্টীবাড়ি মোড়, কাকিনা মোড়, উত্তরবাংলা মোড়, তুষভান্ডার হাই স্কুল মোড়, হাতীবান্ধা মেডিকেল মোড়, পাটগ্রাম কলেজ মোড়, পাটগ্রাম বাইপাস মোড় প্রভৃতি। এসব মোড় আল্লাহর উপর নির্ভর করে যানবাহনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হয়।

Nagad

বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম জানান, কোনো অঞ্চলের উন্নয়নের সূচক সেই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। যোগাযোগ ব্যবস্থা যত ভাল, সেই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত সমৃদ্ধ। সেই তুলনায় উত্তরের জেলা লালমনিরহাট তলানিতে পড়ে আছে। যোগাযোগ উন্নয়ন বঞ্চিত একটি জেলার নাম লালমনিরহাট। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে লালমনিরহাট জেলাকে নিয়ে পৃথক পরিকল্পনার কথা সরকার ভাবে। সেই সময় নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল তিস্তা নদীর উপর পৃথক সড়ক সেতু ও লালমনিরহাট-বুড়িমারী স্থলবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার সড়কটি ফোর লেন করার। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এসে নেতারা প্রতিশ্রুতি দেয় ফোর লেন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় হয়েছে। এভাবে গড়িয়ে গেছে ২৮ বছর।লালমনিরহাট-বুড়িমারী ফোর লেন হয়নি। তিস্তা নদীর উপর নির্মাণ হয়েছে দুইটি সেতু। আওয়ামী লীগ সরকার রয়েছে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায়। এবার অন্তত ফোর লেন রাস্তাটি হবে বলে জনসাধারণ আশা করছেন। এবারে বুড়িমারী সড়কে ফোর লেন না করে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তা সংস্কার করা হচ্ছে।

লালমনিরহাট সড়ক ও জনপদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাট-বুড়িমারী সড়কটি জাতীয় অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে সেই ১৯৮৯ সাল হতে। দেশের চতুর্থ দেশীয় বৃহত্তর স্থলবন্দর বুড়িমারী। বুড়িমারীতে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা এটি। প্রায় ১০০ কিলোমিটারের রাস্তাটি প্রস্থের দিক হতে অত্যন্ত সংর্কীণ, মাত্র ১৫ ফিট। একটি গাড়ি চললে, অন্য একটি গাড়িকে দাঁড়িয়ে সাইড দিতে হয়। এই রোডে দিন রাত্রি ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৫০ হাজার ছোটবড় যানবাহন চলাচল করে। তারমধ্যে পণ্যবাহী ২২ চাকার ট্রাক চলে অন্তত দুই হাজার। পাথর, বালু ও পণ্যবাহী টাকাতো রয়েছে। যানবাহনের চেয়ে রোড ক্যাপাসিটি অনেক কম। তাই দুর্ঘটনা এখানে নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লোকাল স্পেসসহ ফোর লেন না হলে দিন দিন এই দুর্ঘটনা বেড়েই চলবে। লালমনিরহাট সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ সাইফুল্লাহ সরদার জানান, সড়কের পাশে মার্কেটের স্থানগুলো ৭ দশমিক ১৫ মিটার করে প্রশস্থ করা হচ্ছে। ফোর লেন রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই। পুনরায় জলঢাকা হতে বুড়িমারী পর্যন্ত ফোর লেন সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। দিন দিন বুড়িমারী মহাসড়কে যানবাহন বাড়ছে, সেই তুলনায় রাস্তা বাড়ছে না। ফলে সড়কটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।