ডিজিটাল হুন্ডি :তিন মাসে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, গ্রেপ্তার ৫

সারাদিন ডেস্কসারাদিন ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:১৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৯, ২০২৪

দুবাইয়ে বসে ‘জেট রোবোটিক’ নামে একটি অ্যাপস ও নিজস্ব এজেন্টের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী রেমিট্যান্স পাঠানোর দায়িত্ব নিতেন কুমিল্লার শহিদুল ইসলাম ওরফে মামুন। তিনি ২০২০ সাল থেকে দুবাইতে আছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বসে নিজস্ব এজেন্টের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স পাঠানোর দায়িত্ব নিতেন তিনি। গত তিন থেকে সাড়ে ৩ মাসে তিনি ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছেন জেট রোবোটিক অ্যাপের মাধ্যমে।

তবে তিনি চাহিদা অনুযায়ী প্রবাসীয়দের স্বজনদের কাছে টাকা পাঠিয়েছেন। এজন্য ব্যবহার করা হয়েছে চট্টগ্রামের বিকাশ ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটসকে। প্রতিষ্ঠানটির ৪৮টি এজেন্ট সিমে আগে থেকেই সমপরিমাণ বা তার বেশি অনলাইন মানি সংগ্রহ করে রাখা হয়। এরপর ওইসব এজেন্ট সিম থেকে অ্যাপস ব্যবহার করে প্রবাসীদের স্বজনদের নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দিয়ে আসছিল সংঘবদ্ধ চক্রটি।

বুধবার (২৭ মার্চ) দিবাগত রাতে চট্টগ্রামে অভিযান পরিচালনা করে এই ডিজিটাল হুন্ডি কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত জেট রোবোটিক অ্যাপসের ব্যবহারকারী ও মূলহোতা মামুনের দুই সহযোগীসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার।

সিআইডি বলছে, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) প্রায় এক মাস ধরে অনুসন্ধান করে এই চক্রের সন্ধান পায়। এই চক্রের কারণে রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল দেশ। অনেকের অবৈধ উপার্জনের টাকা এই চক্রের মাধ্যমে বৈধ হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বিকেলে মালিবাগে নিজ কার্যালয়ে সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন নাসির আহমেদ (৬২), ফজলে রাব্বি সুমন (৩২), মো. কামরুজ্জামান (৩৩), খায়রুল ইসলাম (৩৪) ও জহির উদ্দিন (৩৭)। তাদের মধ্যে নাসির ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের মালিক। ফজলে রাব্বি ও মো. কামরুজ্জামান ডিস্ট্রিবিউশন হাউজে কাজ করেন। আর পরের দুজন দুবাই থেকে শহিদুলের পাঠানো প্রবাসীদের আত্মীয়স্বজনের অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে দিতেন।

Nagad

সিআইডির প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, এই চক্র দুই ভাগে হুন্ডির কাজ পরিচালনা করে। দুবাইয়ে থাকা চক্রের সদস্যরা প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করেন। আর দেশে থাকা চক্রের সদস্যরা ওই প্রবাসীর দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনদের এমএফএস অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়। এতে প্রবাসীদের মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স আসত, সেটা ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের কালোটাকার মালিকেরা এই চক্রের মাধ্যমে তাদের অবৈধ উপার্জন বৈধ করছেন। আর এই পুরো কাজটি পরিচালিত হতো জেট রোবোটিকস অ্যাপের মাধ্যমে।

সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির প্রধান আরও বলেন, চক্রের সঙ্গে এমএফএস কোম্পানির চট্টগ্রামের তাসনিমা অ্যাসোসিয়েট নামের একটি ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের লোকজন জড়িত। তাদের কাছ থেকে কম লেনদেন হয় এমন এমএফএস এজেন্ট অ্যাকাউন্ট সংগ্রহ করতেন চক্রের সদস্যরা। বিনিময়ে ডিস্ট্রিবিউশন হাউজের লোকজন হুন্ডির লাভের টাকার একটি ভাগ পেতেন।

মোহাম্মদ আলী বলেন, এই চক্রের মূলহোতা শহিদুল ইসলাম ওরফে মামুন। তিনি ২০২০ সাল থেকে দুবাই বসবাস করেন। মালয়েশিয়ান একটি সফটওয়্যার কোম্পানির মাধ্যমে অ্যাপটি তৈরি করে দুবাই বসে শহিদুল হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই অ্যাপের সঙ্গে একটি এমএফএস কোম্পানির ৪১টি অ্যাকাউন্ট নম্বরের সংযোগ ছিল। গত তিন মাসে ওই ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের প্রায় ১৫০টি এজেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছে চক্রটি।

সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আলী বলেন, একটি ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের অধীন প্রায় ১ হাজার ১০০ এজেন্ট থাকে। যেসব এজেন্ট অ্যাকাউন্টে লেনদেন কম হয়, সেই সব অ্যাকাউন্ট হুন্ডির কাজে ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে এমএফএস কোম্পানির নজরদারির ঘাটতি রয়েছে।

নতুন নতুন অ্যাপসের মাধ্যমে কৌশলে এ ধরনের ডিজিটাল হুন্ডি কার্যক্রম চলতে পারে উল্লেখ করে সিআইডি প্রধান বলেন, এ ধরনের কার্যক্রমরোধে সিআইডিসহ সব দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানকে ইন্টেলিজেন্স, মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে।

তিন মাস ধরে অস্বাভাবিক লেনদেন হলো, রেমিট্যান্স ব্লক হলো অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক টের পেলো না? তাদের তো একটা শক্তিশালী মনিটরিং সেল রয়েছে? জানতে চাইলে সিআইডি প্রধান বলেন, ব্যর্থতা বলবো না, সার্ভিলেন্স সিস্টেমে কে কতোটা পেট্রলিং করছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের পেট্রলিংয়ে এটা ধরতে পেরেছি। এটার দায়িত্ব কিন্তু শুধু সিআইডির নয়, ডিবি, র‌্যাব, বাংলাদেশ ব্যাংকেরও।

হুন্ডিতো আগেও হতো, এটাকে ডিজিটাল হুন্ডি বলছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই সিস্টেম আসলেই ডিজিটাল হুন্ডি। আগে ফোন করে বলে দিতো অমুকের টাকা অমুককে দিয়ে দাও। ম্যানুয়াল সিস্টেম। কিন্তু এখন এসবের দরকার নাই। ফোন বা লোকাল এজেন্ট অথবা ডিস্টিবিশন হাউজ দরকার পড়ে না। অ্যাপস যেভাবে ইন্সট্রাকশন দেবে সেভাবে নম্বরে নম্বরে টাকা চলে যায়।

তাহলে বাংলাদেশে কীভাবে পেমেন্টটা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই জেট রোবোটিক অ্যাপসে বেশ কিছু এজেন্ট বাংলাদেশে আছে। তারা টাকা সংগ্রহ করে। তারপর তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটসকে দেয়। তাসমিয়া বিকাশ থেকে ই-মানি সংগ্রহ করে। সেটাই অ্যাপস ব্যবহার করে।

তিনি আরো বলেন, বেআইনি কার্যক্রম হলে এটা দেখার দায়িত্ব কিন্তু সংশ্লিষ্টদের। টেরিটরি অফিসার, ফিল্ড অফিসার সবাই কিন্তু মামলার আসামি হবে। কারণ ৪০০ কোটি টাকা সমমূল্যের রেমিট্যান্স ব্লক করে আটকে দিয়ে লোকালি টাকায় লেনদেন যে এজেন্ট সিমে করা হয়েছে। সংখ্যাটি একেবারে কম না, ৪৮টা সিম ব্যবহার করা হয়েছে।