কল সেন্টারের চাকরি জন্য কখনও সার্টিফিকেটের গুরুত্ব দেই না: তৌহিদ হোসেন
দেশের কল সেন্টার, আউটসোর্সিং-পেশাকে তরুণ-তরুণী মাঝে জনপ্রিয় করার জন্য যে মানুষগুলো নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন-তাদের মধ্যে অন্যতম তৌহিদ হোসেন। মানুষটি এই খাতের খুবই পরিচিত মুখ। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এই খাতটিকে এগিয়ে নিতে নিরলস ভাবে কাজ করছেন। তিনি দীর্ঘ বিশ বছর যাবত এই আইসিটি ইন্ড্রাস্টিতে আছেন। গড়ে তুলেন নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ফিফোটেক। যেখানে তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন। এছাড়াও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কন্টাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্কো) সাধারণ সম্পাদক পদেও আছেন। কঠোর পরিশ্রম করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের- ফিফোটেককে দেশের একটি অন্যতম সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছেন। এখন স্বপ্ন দেখছেন এই প্রতিষ্ঠানে একসাথে পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করার।
ইঞ্জিনিয়ার, মেধাবী এ ব্যবসায়ী- তরুণ প্রজন্মকে নিয়েই ব্যস্ত। তরুণ প্রজন্মকে উদ্যমী ও তাদের স্কিল ডেভেলপমেন্টেও কাজ করছে তার প্রতিষ্ঠান। এখানে কাজ করছেন একঝাক তরুণ-তরুণী।
সম্প্রতি রাজধানীর রাজধানীর জনতা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের ফিফোটেকের অফিসে সারাদিন ডট নিউজের সাথে কথা বলেন তৌহিদ হোসেন। এ সময় তিনি, কল সেন্টারে চাকরি, আউটসোসিংয়ের কাজের যোগ্যতাসহ এখন কোন কাজ শিখলে সমাজের বোঝা নয়, দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত হবে-সে বিষয়ে খোলামেলা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র প্রতিবেদক- শাহজালাল রোহান।
সারাদিন ডট নিউজ: দীর্ঘদিন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ করছেন। এই মুহূর্তে আসলে কি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন?
তৌহিদ হোসেন: আমি দীর্ঘ বিশ বছর ধরে আইসিটি সেক্টরে কাজ করছি। দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমায় প্রথমে কাজ করেছি-নিজের প্রতিষ্ঠান ফিফোটেক-এর সলিউশন নিয়ে, এরপর বিপিও-তে। শুরুটা কল সেন্টারের হলেও, এর সাথে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংয়ের যে অনেক গুলো ক্ষেত্র নিয়ে-ফিফোটেক কাজ করছে। মানুষ যদি বলে-ফিফোটেকের ব্রেড অ্যান্ড বাটার কি-কিভাবে সারভাইভ করছি; বলব, আমাদের কল সেন্টর রয়েছে। যা দিয়ে বাংলাদেশ ও দেশের বাহিরেও সার্ভিস দিচ্ছি। আমাদের রয়েছে ডাটা এন্ট্রি সার্ভিস। যেটা রিয়েল টাইম, অফলাইন-অনলাইন দুটো জায়গায় আমরা কাজ করছি। এখানে আমাদের অনেক বড় একটি টিম কাজ করছে। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে বড় একটি টিম কাজ করছে। আমাদের ট্রেনিং ডিপার্টমেন্ট রয়েছে; এটিও বেশ বড়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতে আমরা ট্রেনিং করাচ্ছি। অনেকগুলো সরকারি ট্রেনিং গুলো আমরা করাই; সরকার পার্টনার হিসেবে আমরা পেয়েছি। আমাদের একটি ট্রেনিং আছে, যেখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আমরা ট্রেনিং করাচ্ছি। যারা গ্রাজুয়েশন করেছেন , তারা চাইলেই এই ট্রেনিং টা করে চাকরির সুযোগ হবে। যেখানে আগে ট্রেনিং করতে গেলে টাকা খরচ করতে হতো; এখন উল্টো। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগটা আছে। এই ট্রেনিং চলা অবস্থায় আবার টাকাও দেওয়া হয়। এটা খুব ইন্টারেস্টিং। ফ্রি ট্রেনিং করব; আবার টাকাও পাব। ফিফোটেকের এই কাজগুলোর সাথে সাথে দেশের বাহিরে দুবাই এবং আমেরিকায় আমাদের সাব-অফিস রয়েছে। যেখান থেকে কাজ খোঁজার চেষ্টা করি এবং কাজ নিয়ে এসে বাংলাদেশ আমরা করছি।
ফিফোটেক ছাড়াও আমি আরও কিছু কাজ করছি দীর্ঘ সাত থেকে আট বছর। সেটা হলো গোল্ডেন ফাইবার এশিয়া। এখানে আমরা পাট নিয়ে কাজ করি। জুটের ডাইভারসিটি প্রোডাক্ট। পাট দিয়ে যে কত রকম পণ্য তৈরি করা যায় এবং এই পণ্যের চাহিদা বাংলাদেশে তো আছেই, বহির্বিশ্বেও অনেক বেশি। সেই মার্কেট বাড়ানো কাজ করছি। ইতিমধ্যে বেশ কিছু কাজ করেছি। এছাড়াও দেড় বছর আগে আমরা আরও একটি ইনিশিয়েটিভ নিয়েছি। আমি ও উদ্যোক্তা ইকবাল বাহার মিলে; সেটা হলো ‘সেরা বাংলা ৬৪’ যেটা বাংলাদেশের ৬৪ জেলার বেস্ট প্রোডাক্ট নিয়ে এসে আপনাদের হাতের নাগালে পৌঁছে দেওয়া। যেমন ধরুন, দিনাজপুরের সরিষার তেল, বান্দরবানের হলুদ, নওগাঁর চিনি-ইত্যাদি।
সারাদিন ডট নিউজ: বলছিলেন কল সেন্টারের কথা। এটা এখন বেশ জনপ্রিয় হয়েে উঠেছে। এই পেশায়- আপনারা কোন ধরণের লোকবলকে কাজের সুযোগ দেন? নিয়োগের ধরণ কেমন হয়?
তৌহিদ হোসেন: এ পেশায় নরমালি ইন্টারভিউ নিয়েও চাকরি হয়। কিন্তু করোনা মধ্যে আমরা অনলাইনে সব নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। এসময় নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া অনলাইনের মাধ্যমে হয়েছে। অনলাইনে ইন্টারভিউ নিয়েছি, সিলেকশন করে জানিয়ে দিয়েছি, ট্রেনিং করিয়েছি, সব ধরনের লিগাল ডকুমেন্ট নিয়েছি, ব্যাংক একাউন্ট করেছি, অনলাইনে তাদের কাজ করিয়েছি, তাদের কিউসি করিয়েছি, কাজ করিয়েছি। অনলাইনে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করিয়েছি, মাস শেষে বেতনও তারা পেয়ে গেছে। অনেকের সাথে কিন্তু আমাদের ফিজিক্যালি দেখাও হয়নি।পুরো প্রক্রিয়ায় অনলাইনে করেই আমরা তাদের নিয়োগ দিয়েছি। মজার বিষয় হচ্ছে, কল সেন্টারে চাকরি করার জন্য আমরা কখনও সার্টিফিকেট এর গুরুত্ব দেইনা।১৮ বছরের উপরে হলেও আমরা ইন্টারভিউ নেই। আমাদের কাছে সনদপত্র চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, কে শুদ্ধ ভাবে কথা বলতে পারে। কম্পিউটারে কার নলেজ আছে। এবং কাজ করার আত্মবিশ্বাস কার রয়েছে। আমাদের জন্য এগুলো থাকলেই যথেষ্ট।
সারাদিন ডট নিউজ: আউটসোর্সিং কাজের জন্য কোন ধরনের যোগ্যতা দরকার হয়?
তৌহিদ হোসেন: অনেক ধরনের যোগ্যতা দরকার হয় তবে আমাদের কাছে তিনটি যোগ্যতা খুব দরকার হয়। একটি হচ্ছে কমিউনিকেশন স্কিল, কম্পিউটার স্কিল একটা হচ্ছে কনফিডেন্স। এই তিনটা-‘সি’ যদি কেউ জানে, আউটসোসিং এর প্রতিটি কাজ আপনাকে দিয়ে সম্ভব। অবশ্যই কুইক লার্নার হতে হবে। কারণ একটা জিনিষ আপনাকে শেখানো হবে; আপনি অবশ্যই পারবেন।
সারাদিন ডট নিউজ: বলা হয় সব পেশা থেকে এসেই বিপিও সেক্টরে কাজ করা সম্ভব। এ নিয়ে আপনার মতামত কি?
তৌহিদ হোসেন: একটা সময় ছিল যখন জিজ্ঞেস করা হতো জীবনে কি হবে? সবাই বলত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী। এগুলোই বলতো। দেখুন আমি সিএসসি গ্রাজুয়েট। আমি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট- এর লাইভ টাইম মেম্বার। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এক সময় আমার স্বপ্ন ছিল একজন প্রোগ্রাম হব। আস্তে আস্তে কিন্তু আমি একজন বিপিও ব্যবসায়ী হয়ে গেছি। এই যে দেখেন চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট।- যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সবাই কিন্তু আপডেট হয়। যারা তরুণ-তরুণী আছেন তাদেরকে বলতে চাই বিপিও এমন একটি সেক্টর, যেখানে সব প্রফেশন, সব রকম ডিসিপ্লিন, সব ধরণের মানুষজন এসে বিপিও সেক্টরে কাজ করতে পারে। যে ইংরেজিতে গ্রাজুয়েট করবে সেও পারবে, যে ডাক্তারি পেশায় আসে সেও পারবে। আমাদের যারা মেডিকেল হেলথ সার্ভিস নিচ্ছে, তাদের হয়ে কিন্তু কাজ করতে পারবে। বিপিও সেক্টরে প্রতিটি সেক্টরের লোকজনের কাজের সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি দেখেছি। তরুণ তরুণীরা কিন্তু এই বিপিও সেক্টরে বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে।
সারাদিন ডট নিউজ: বিপিও ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
তৌহিদ হোসেন: আমি এমন একটি স্বপ্ন দেখি তিন থেকে চার হাজার লোক একটা ফ্লোরে কাজ করবে। যেগুলো ও ইনফোসিসের কোম্পানিতে দেখা যায়। ৮০ হাজার লোক একসাথে কাজ করে। আমিও টার্গেট নিয়েছি যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখে এবং সুযোগ পাই এই ফিফোটেক-কোম্পানিতে এটলিস্ট পাঁচ হাজার কর্মীর কর্মসংস্থান একসাথে করব।
সারাদিন ডট নিউজ: কল সেন্টার অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার হতে গেলে হতে গেলে কি করতে হবে ?
তৌহিদ হোসেন: আমাদের নাম পরিবর্তন হয়েছে। এখন হয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কন্টাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্কো)। এখন আমাদের ২০০ এর বেশি মেম্বার রয়েছে। আমাদের বাক্য মেম্বার হতে গেলে, আমাদের যে সেক্রেটারিয়েট রয়েছে, ওয়েবসাইটে ডিটেইল দেওয়া আছে। www.bacco.org.bd. বিপিও, আউটসোসিং নিয়ে কাজ করছে যে কেউ আমাদের মেম্বারশিপের জন্য আবেদন করতে পারে। ছোটো করে একটি মেম্বার শিপ প্রসেসিং আছে, যেটা সেক্রেটারিয়েট থেকে গাইড করা হবে। যেটা আবেদর করার ১ থেকে ২ মাসের মধ্যেই ভিতরেই সদস্যপদ পেয়ে যাবেন।
সারাদিন ডট নিউজ: করোনার যে মহামারি গেলো, আমরা দেখেছি আপনার কোম্পানি ফিফোটেক-কোনো কর্মীকে ছাঁটাই করেনি? বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই কাজ করে আপনার প্রতিষ্ঠানে; বিষয়টি নিয়ে যদি কিছু বলতেন।
তৌহিদ হোসেন: আমাদের ফিফোটেক কোম্পানি কোন ধরনের কোনো কর্মীদের ছাঁটাই করিনি। কোনো স্যালারিও কমাইনি। আমাদের কোম্পানিকে কিছুটা চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয়েছে। লোণ করতে হয়েছে। এ সব করায় সবার একটা আন্তরিকতা পেয়েছি। এ কারণে আমাদের কোম্পানিতে যারা কাজ করছে; চাকরি হিসেবে করছে না। আট নয় ঘণ্টা এই নিয়ম বেঁধে কেউ কাজ করে না । দরকার হলে তারা ১৪ -১৫ ঘণ্টাও কাজ করে। এজন্য ফিফোটেকের প্রত্যেককে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এবং তাদের পরিবারকেও ধন্যবাদ দেই; তারা ছাড়া আমাদের আজকের এই পজিশনে আসা সম্ভব হতো না। সবার কাছে চির কৃতজ্ঞ।
সারাদিন ডট নিউজ: তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে কি বলবেন?
তৌহিদ হোসেন: বর্তমান প্রজন্মের তরুণ প্রজন্মের কেন বলতে চাই, ডিপেন্ডেন্সি নির্ভরতা কমাতে হবে। সব সময় আমরা কারো প্রতি নির্ভরশীল থাকি। আমি গ্রাজুয়েশন পাস করলাম, কোন মামা- চাচা চাকরি দিয়ে দিবে। কিন্তু চাকরি হয়তো দিয়ে দিবে; কনটিনিউ কিন্তু করতে পারবেন না। আমি বলব- নিজের স্কিল ডেভলপমেন্ট করার জন্য সময় দিতে হবে। ইংরেজি কমিউনিকেশন-এর কোনো বিকল্প নেই। এখানে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আন্তর্জাতিক কাজ অনেক আছে কিন্তু আমরা নিতে পারছি না। এর কারণ প্রপার ইংলিশ কমিউনিকেশন-এর লোক নেই। কম্পিউটার স্কিল বাড়লে । ফেসবুক ইউটিউবে না- কেউ যদি মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল ভালো জানে; তাহলে কেউ না খেয়ে মারা যাবে না।
সারাদিন/ ৩১মে/ এসআর