পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, হারিয়ে যাচ্ছে লালমনিরহাটের ২৫০ তাঁত পরিবার

হাসানুজ্জামান হাসান:হাসানুজ্জামান হাসান:
প্রকাশিত: ৪:৪১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১২, ২০২২

তাঁত শিল্প, হাতে বুনন। যে বাক্যটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে দেশের মধ্যাঞ্চল কিংবা পাহাড়ি কোনো জনগোষ্ঠীর কথা। তবে যুগ যুগ ধরে সীমান্ত জেলা লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নে ২৪৫টি ঘরে হাতে বুননের এ শিল্পটি আগলে রেখেছে। বাপ-দাদার রেখে যাওয়া পেশা বদল করেনি অনেকেই। এ পেশায় এখন পেট চালানো দায়। তাই কেউ কেউ বছরের অর্ধেক সময় চলে যান শহরে, অন্য কোনো কাজে। যারা আছেন- তারাও দিনের অর্ধেক সময় অন্য পেশায় শ্রম দেন। মহিলা আর বৃদ্ধরাই এখন মূল কারিগর। চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন অনেক তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন কেউ নিজেদের জড়াচ্ছেন না এ পেশায়। অথচ এ পেশা কেন্দ্রিক সঠিক বাজার তৈরি হলে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হতে পারে বলে ধারণা অনেকের।

জেলায় কোনো বুটিক-বাটিক, হ্যান্ডিক্রাপ্টের বাজার নেই। ডিলার বা বড় ব্যবসায়ী নেই। এগিয়ে আসেনি কোনো সংস্থাও। বিনিয়োগ করেনি কেউ। নেই কোনো প্রকার প্রণোদনা। লালমনিরহাটের ২৪৫ ঘরের এ ব্যবসাযকে অন্য কোথাও পরিচয় করিয়েও দেয়নি কেউ। যার ফলে বাড়েনি ছটাক পরিমাণ ব্যবসা।

কারিগররা বলছেন, স্থানীয় ছোট পরিসরের বাজার। নেই ছোট বড় কোনো বিনিয়োগ। ঋণ সুবিধার আওতায় আনলে তারা তাদের এ তাঁত শিল্পের মাধ্যমে তৈরি করতে পারবেন নতুন এক অধ্যায়।

দীর্ঘদিনে বাজার গড়ে না ওঠা যেমন একটি বড় সমস্যা। এর সঙ্গে সুতার দাম বৃদ্ধি, সুতার পরিবহন খরচ, রেশমি সুতার উৎপাদনের মতো সমস্যাও ধীরে ধীরে প্রকট আকার ধারণ করছে। এ শিল্পের প্রধান উপকরণের পাইকারি বাজার বগুড়ায় যেতে হয় সুতা কিনতে। তারপরও ৫০০ টাকা জোড়ায় দিনে ১০টি চাদর পরিমাণ উৎপাদিত কাপড় বিক্রি করে ৪ সদস্যের একটি পরিবার দিব্বি চলে যাবে। এক সময় হলেও, এখন স্থানীয় একটি মাত্র খুচরা বাজারে বেচা-বিক্রি দিয়ে আর হচ্ছে না। এখন অন্য জেলার বাজার ধরতে হবে।

সরেজমিনে কাকিনা ইউনিয়নের তাতী পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, চরকি ঘুরিয়ে সুতা তৈরি ও সোয়েটার বুনছিলেন ৫৫ বছরের শরিফা বেগম। তিনি বলেন, আমরা সোয়েটারসহ সব রকম কাজ করতে পারি। শুধু এগুলো করে এখন আর পুষিয়ে উঠতে পারছি না। বাধ্য হয়ে অন্যের কাজ করতে হয়। আমার স্বামী মিস্ত্রির কাজ করেন। কোনো রকম পিতৃ-পুরুষের পেশা ধরে রেখেছি। আর্থিক অনুদান পেলে আমরা আরও ভালো কাজ করতে পারব।

একই গ্রামের ৭০ বছরের হালিম মিয়া বলেন, আমাদের তাঁতিদের বিশাল সমস্যা। আমরা হাঁটুপানিতে ডুবাডুবি করছি। আমাদের আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন। আমরা আগে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে সুতা কিনতাম। এখন ৫৫০ টাকা কেজিতে কিনতে হচ্ছে। তবুও সুতা পায় না। আগে ঢাকাসহ বড় শহর থেকে লোকজন দেখতে আসত। যাওয়ার সময় ১০-২০টা তাঁতের পণ্য নিয়ে যেত। আগে সব সময় ২০০ থেকে ২৫০টি তাঁত চালু ছিল। এখন ৬ মাস চালু থাকে, ৬ মাস বন্ধ। সচল তাঁত আছে ৮ থেকে ১০টি।

Nagad

তাঁতি শফিকুল ইসলাম বলেন, বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছি। আমি নিজেই ৬ মাস এ কাজ করি। কোনো সংস্থা বা সরকার যদি সহায়তা বা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতো, তবে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম। বর্তমানে প্রতি জোড়া চাদর কাকিনা বাজারে ৫০০ টাকা জোড়া বিক্রি হয়। বাইরের কোনো ক্রেতা আমাদের নেই।

কাপড় ও পোশাক বিক্রেতারা বলছেন, কাকিনার তাঁতের পণ্য মানে অনন্য। আধুনিক প্যাকেজিং ও একটু প্রচারণা হলেই আরও বেশি ক্রেতা আকৃষ্ট করতে পারবে এবং বেচা বিক্রিও বাড়বে। বাইরের পাইকারি বাজারও ধরা যাবে।

স্থানীয় সুধী সমাজ মনে করেন, এ তাঁতিদের কাজে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে কাকিনার এ তাঁত ঘুরে দাঁড়াবে। এদের পণ্যের কদর তো আছেই, বাড়বে প্রসার। এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, এনজিওরা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।

উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, উপজেলাতে বেশকিছু তাঁতশিল্প আছে বলে আমি জানতে পেরেছি। উপজেলা প্রশাসন থেকে তাদের জন্য সার্বিক সহযোগিতা থাকবে। খুব শীঘ্রই আমরা তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত মানুষদের সাথে সরাসরি কথা বলব।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, রংপুরে তাঁত বোর্ড আছে। সেখানে তারা যোগাযোগ করতে পারে। এছাড়া সরকারের যে ডিপার্টমেন্টগুলো থেকে সহযোগিতা পেতে পারে, সেই সব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের লোন আছে, এগুলো তারা নিতে পারে। আর তাদের প্রতিটি কাজে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

সারাদিন. ১২ ডিসেম্বর.