মন খোরাকের হড়কাবান: আসাদ পলাশ

আসাদ পলাশ:আসাদ পলাশ:
প্রকাশিত: ৮:০৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১০, ২০২৩

মাথার উপর খণ্ড খণ্ড আকাশ, কখনো নীল কখনো ধূসর, কখনো সাদা মেঘের ভেলা, মাঝে মধ্যে উঁকি ঝুঁকি চাঁদের ফাঁকিবাজি। চুপি চুপি এক পশলা বৃষ্টি এলো রাতের নিমন্ত্রণে। মেঘের গর্জনে হুমায়ূন আহমেদের কবিতার মতো পেয়ে যাই আমার আমন্ত্রণ “যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো চলে এসো এক বরষায়, এসো ঝরো ঝরো বৃষ্টিতে জল ভরা দৃষ্টিতে, এসো কমলো শ্যামলো ছায়, চলে এসো এক বরষায়।”

রাত ১২টায় ছয় শওয়ারীর কলের গাড়ী ছুটে চলে মনের খোরাক জোগাতে রাঙ্গামাটি। গান আর গল্পের তালে তালে পৌঁছে গেলাম ফেনী। যাত্রা বিরতিতে ফেনী বাসীর প্রিয় খাবার-চানা ডাল আর পরোটার লোভ সামলাতে পারিনি। এখন আর আগের মতো খেতে পারি না। বড় সাইজের মাত্র দুটো পারটা. তারপর চা। মহীপালের রাস্তায় বিপদের সম্ভাবনা থাকায় ফেনীতে ভোরের অপেক্ষা। আরও কিছুক্ষণ সময় ক্ষেপণ। বড় মসজিদে ফজরের সালাদ আদায় করে, রওনা।

ছোট ভাই-মামুন যখন ভুঁড়ি কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে কিঞ্চিৎ ভুল জানান দেয়, “ভাইয়া মোবাইলতো উল্টা করে ধরা”, আমরাতো ভুল পথে এসেছি, সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। এই রকম ছোট খাটো ভুল না হলে ওকে-মামুন মামুন মনে হয়না। ইতোমধ্যে ছাগলনাইয়া দিয়ে ভারত বর্ডারের কাছাকাছি চলে আসি। দুটো ছোট ছোট ভাঙ্গা লোহার ব্রিজ পারাপার, স্টারিংয়ে বসার শখ মিটে যায়। সরু, ভাঙ্গা, কাঁদা, পিচ্ছিল ব্রিজ, যাই হোক চার/পাঁচ মাইল উল্টা পথ পাড়ি জমাই সঠিক পথের সন্ধানে। মহীপাল থেকে করেরহাট হয়ে রামগড় চা বাগানে বিরতি, ফোটসেশন। এরপর জালিয়াপাড়া বাইপাস দিয়ে সিন্দুকছড়ি, মহালছড়ির হয়ে রাঙ্গামাটি পর্যটন কেন্দ্রে।

সিন্দুকছড়ি পৌঁছে মন খুশিতে ভরে গেলো। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরি হয়েছে উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা রাস্তা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর সিন্দুকছড়ি থেকে মহলছড়ি পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার সড়ক তৈরি করেছে মূল পাহাড়ের কোন ক্ষতি না করে। সঠিক রেখে, রাস্তায় যাতে বৃষ্টির পানি জমতে না পারে সেজন্য ইউরোপের আদলে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। এ-ই সড়ক খাগড়াছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি যাতায়াত সহজ করেছে। দুইপাশে অপরূপ দৃষ্টি নন্দিত সবুজের সমারোহের মধ্যে আঁকাবাঁকা রাস্তা নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীতে এক নতুন মাত্রা। দুর্গম পাহাড়ের বুকে আঁকাবাঁকা সড়ক, আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখতেই মানুষ এখানে ভিড় জমায়। পাহাড়ে বাইকারদের স্বর্গ সড়ক, রাস্তাটা খুলে দেবার পর থেকেই বাইকারদের ভিড়।

সিন্দুকছড়ি থেকে মহলছড়ি পর্যন্ত রাস্তাটা অনেকটা ভারতের দার্জিলিংয়ের মতো। মাঝে মাঝে লাদাখ বা সিকিমের মতো মনে হয়েছে। বিশ্বমানের গুনগত মান, ষোল কিলোমিটার দীর্ঘ ও আঠার ফুট প্রশস্ত সড়কে সাইড ড্রেন, কালর্ভাট, গ্রাভেটি, রিটেইনিং ওয়াল ও প্যালাসাইডিং সহ সব সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে। মাঝে মাঝে থেমে থেমে ফটোসেশনের কথা নাইবা বললাম। পথের বাঁকে বাঁকে যে চোখ ঝলসানো রূপ তা উপেক্ষা করার সাধ্য কার। জালিয়াপাড়ায় কিছু কিছু বাঁক যেমন সুন্দর তেমনি মন হরন করা। পাহাড়ি রাস্তা যাদের পছন্দ তাদের কাছে এই রাস্তা স্বপ্নের মতো মনে হবে, বিহঙ্গমার পিঠে চড়ে এঁকে বেঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে মেঘের দেশে, নিজেকে মনে হবে স্বাধীন যাপিত বোহেমিয়ান। মনে হবে ইচ্ছে ঘুড়ি লাটায়ের সম্পর্ক ছিঁড়ে বাকাট্টা, খেয়াল খুশী মতো হেলে দুলে পূরণ করছে মনের বাহানা। পাহাড়ের গা জুড়ে দূর বহু দূর পর্যন্ত বিছানো সবুজ গালিচা, হঠাৎ মনে হবে মৃন্ময় চোখ হয়ে উঠেছে মৃগো লোচন, আনন্দ ঝড়ে দৃষ্টি সোপানে মত্ত বিহু, জীবনে বেজে উঠে জাগোর বীণ, মৃদু বাতাসে, তপ্ত রোদে মেঘমেদুর আকাশে, শরীর জুড়ানো মলয় বাতাস। সব কিছু মিলিয়ে প্রকৃতির নৈবেদ্য সৌন্দর্য গুলাব সুগন্ধি ছড়ায় হৃদ মাঝারে।

রাঙ্গামাটি এলাকায় পর্বতরাজি গড়ে উঠে টারশিয়ারি যুগে। এই যুগের মাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লালচে বা রাঙা। তাই এই জনপদের নাম হয়েছে রাঙামাটি। তাছাড়া নামকরণটির বিষয়ে বহুল প্রচলিত গল্প হচ্ছে:- বর্তমান রাঙামাটি জেলা সদরের পূর্বদিকে একটি ছড়া ছিল, যা এখন হ্রদের নীচে তলিয়ে গেছে। স্বচ্ছ পানি যখন লাল মাটির উপর দিয়ে ঢাল বেয়ে গড়াতো, তখন তাকে লাল দেখাতো। তাই এই ছড়ার নাম হয়েছিল ‘রাঙামাটি’। অনুরূপ, সদরের পশ্চিমে আরও একটি ছড়া ছিল। একই কারণে তার নাম দেয়া হয়েছিল ‘রাঙাপানি’। এই দুই রাঙা ছড়ার মোহনার বাঁকেই গড়ে উঠেছে বর্তমান জেলা শহর। যা মূলত ছিল অনাবাদী টিলার সমষ্টি এবং বহু উপত্যকার এক নয়নাভিরাম বিস্ময়-ভূমি। এই দুই ছড়ার নাম অনুসারে ‘রাঙামাটি’ জেলার নামকরণ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। রাঙ্গামাটির পূর্বের নাম ছিল-কার্পাস মহল।

Nagad

আয়তনের দিক থেকে রাঙ্গামাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জেলা, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান ধর্মাবলম্বী সহ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, লুসাই, সাঁওতাল ও মনিপুর সহ বহু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টী বাস করে। বাংলাদেশের একমাত্র জেলা যার ভারত ও মায়ানমার এ-ই দুই দেশের সাথে আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। রাঙ্গামাটিকে “সিটি অব লেক” ও বলা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই অঞ্চলের ছাত্র জনতার ভূমিকা অপরিসীম, তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক জনাব আব্দুল আলী সহ অনেককেই পাকিস্তানী আর্মি নৃশংসভাবে হত্যা করে।

বৃষ্টি ভেজা পাহাড়, জল, কাদামাটি গড়ায় উপর থেকে, পাহাড় ধসের চিন্তাও মাথায় ছিল। ধপাস করে না রাস্তায় ভেঙে পড়ে, বৃষ্টির পানি রাস্তা পারাপারের জায়গা গুলো ছিল খুব বেশী পিচ্ছিল, সাবধানে এগুতে হচ্ছিলো। সব দুশ্চিন্তা সুন্দরের কাছে হারমানে। রাঙ্গামাটি শহরে ঢুকেই আমিতো হতবাক, খুশিতে অত্মহারা, টিলা পাহাড়ের শহরে এমন তেলতেলে, মসৃণ, চওড়া রাস্তা, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ভ্রমণের আনন্দ বাড়িয়ে দেয়। এই শহর বাংলাদেশের একমাত্র রিক্সাবিহীন শহর। বলে রাখি, সুখ মূল্যবোধ এক অমূল্য অসুখ আমাকে অর্ন্তদাহ থেকে বাচায়, সুখ কেনা যায়না, কুড়াই, উড়াই আর প্রিয়জনদের সাথে ভাগাভাগি করি, এইযে আমার রৌদ্রুর ঠিকানা, জলের কিনারা,পাহাড়ের নিশানা সব সব কিছু মিলেই আমার অনাবিল সুখের আঙ্গিনা।

প্রথম দিন পর্যটন কেন্দ্রে আস্তানা গেড়ে দুপুরে আহারের পর চলে যাই আসাম বস্তি রোড ধরে রাঙ্গামাটি কাপ্তাই লিংক রোড। বরগাং ব্রিজে দাঁড়িয়ে কাপ্তাই লেক দর্শন, স্বচ্ছ জলের উপর ছোট ছোট নৌকাগুলো জল তরঙ্গ সৃষ্টি করে এগিয়ে চলে। ঝোপের আড়ালে কৌতূহলী পাখির অনুসন্ধানী দৃষ্টি, খেয়া পারাপারের মানুষ জনের মুচকি হাসি, এই বৃষ্টি এই নাই, বাজারে চা আর শহরে শহীদ মিনারে জম্পেশ আড্ডা-সব সবকিছু তুলে রাখলাম স্মৃতি ফলকে।

পরদিন ঠিকানা পরিবর্তন করি। নতুন ঠিকানায় যেতে যেতে মন বিষম খায়, সরু অলি গলি পার করে মনে হলো ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটছি, কিন্তু হায় ডিঙ্গি হোমইস্টে উঠার পরই আফসোস হতে লাগলো, কেনো যে আগের দিন এই “আমরা-বতী” উঠলাম না? কাপ্তাই লেকের কিনারে টিন আর কাঠ দিয়ে তৈরি ডিঙ্গি, আলো ছায়া গায়ে মেখে সেজে বসে থাকে দূর পাহাড়, সূর্যের কিরণ আলিঙ্গন করে লেকের জল, মাঝে মাঝে ছুঁড়ে দেয় কিছু ঝিলিক ঝিলিক আলোক রশ্মি। পাখীগুলো পাকা শিকারি, হাঁসেদের জলকেলি, অলস কচুরিপানার দল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভেসে যায় স্রোতের টানে। বৃষ্টির ফোটা জল ছুঁয়ে সৃষ্টি করে বৃত্ত, অজস্র, লক্ষ কোটি বৃত্তে নিজেকে হারাই, ডুবি আবার ভাসি। অথৈ জলের মাঝে ছোট একটা দ্বীপ। হাঁসেরা আশ্রয় নেয় খোলা আকাশের নিচে, বৃষ্টির মিছিলে পুলকিত পাগলা পবন, গম্ভীর শ্লোগানে ঝলিকে বিজলি জ্বেলে মুখরিত গগন। স্বপ্নচারীরা ভ্রমণ করি আকাশের আঙ্গিনা, কাঠের পাটাতন বারিন্দায় শুয়ে শুয়ে দেখি বিস্ময়ের আড়ালে অনাবিল সুখ।

ভালবাসা ডাকাতি করে নেয় একটা অস্তায়মান সূর্যের রক্তিম আভা, বাতাসে ভেসে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা গুলো আলোক তরঙ্গকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে লাল আলোর বিক্ষেপণ কমিয়ে তৈরি করে লাল আকাশ লাল। এমনি একটা আবির লালে রাঙ্গানো বিকেল, সাঁঝ শুরু হয় রং বেরংয়ের জটিলতায় লুকানো সরলতা নিয়ে, সূর্যের মতামত উপেক্ষা করে নেমে আসে স্নিগ্ধ সন্ধ্যা। ভাঙ্গে আকাশ, ভাঙ্গে রং আর গড়ে প্রতিবার, দিশাহারা জটলা পাকায়, উদাস বারবার। এমন নানা রঙ্গের পাগল করা সন্ধ্যা জীবনে কোনদিন দেখেছি বলে মনে হয়না, বর্ষায় রাঙ্গামাটির আকাশ রং বদলায় ক্ষণে ক্ষণে।

ওহে পথ তুমি পথ দেখ, আমার পথে হেঁটোনা, আমি ছুটি জলে, মনের বাসনা, কাপ্তাইয়ের জলে নাও ভাসিয়ে সারাটা দিন পার করে দেই। পাথরের গায়ে খাঁচ কাটা খাঁচ কাটা আলপনা নিয়ে দাড়িয়ে থাকা পাহাড় কি যে অপূর্ব শৈল্পিক শৈল্য, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। খাদ্যের অন্বেষণে পাখিগুলো নেমে আসে জলে, হাঁসদের জলকেলি, দূরে সারিবদ্ধ পাহাড় গুলো দেখে মনে হয় ছুঁয়ে দেওয়া যায় হাত বাড়ালে। আবারও মামুনের কথা বলতে হয়, দু’চোখে জল, কুল, আকাশ, মেঘ দেখতে দেখতে মুগ্ধতার চরমে ঠিক তখনই একটা ঢেউয়ের আঘাতে চিৎপটাং। যতটা না ভয়ে তার চাইতে বেশী ভয় দেখাতে বিকট চিৎকার। আমরা ভীষণ ভয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি।

শুভলং ঝর্ণা-দেখে ফিরতি পথে নির্জন দ্বীপে নেমে পড়ি শীতল জলে গা ভিজাবো বলে। জলের পিঠে রোদের পেখম, ঝিকিমিকি আলোর ভেলা, জল বৃত্তে নিজেকে দেখে বিহ্বল, বিমুগ্ধ, খুঁজে পাই নিজেকে। এইতো আমি, এইযে এখানে। প্রতিদিন ব্যস্ত সকালে আয়নার সামনে চুল আঁচরাই কিন্তু নিজেকে দেখার সময় দেয় না সময়, মুহূর্তগুলো পাকড়াও করে বুলেট ট্রেনের চেয়ে দ্রুত চলে যায় সময়। তপ্ত দেহ জুড়াই জলে, জলকেলি খেলা, আমার দ্বাদশ শ্রেণী পড়ুয়া ছোট ছেলে মনের আনন্দে সাঁতার কাটে। দলের অন্য সদস্যরাও হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠে, রোদের ক্লান্তি ঝেড়ে ফিরে আসি ডিঙ্গিতে।

ভালবাসা অতিক্রম করি আরও বেশী ভালবেসে, নিঃশেষে, মনের খুব গভীরে লুকিয়ে থাকা ভালবাসার ম্যাপে চঞ্চল স্রোত, সুনীল বলে” তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশী দেখি যখন দেখিনা,” আমি তা বলিনা, আমি দেখতে ভালবাসি যখন দেখি, তাইতো বারবার ছুটে আসি। প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পাই নিজেকে, কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়ে ছুটে বেড়াই এখানে সেখানে, ক্লান্তি অবসাদ দেহে থাকলেও মনে ধারণ করি সুখ বিলাস। সফর সঙ্গী রিপন, মনির, আমার ছোট ছেলে সামিন আর যার সাথে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ বেড়ে যায় বহুগুণে, জীবন সঙ্গিনী, ধন্যবাদ সবাইকে। এসেছি অনেক, আসবো অনেক, বারবার আসার অভিপ্রায়।

সারাদিন. ১০ জানুয়ারি.