৩১ জানুয়ারি ১৯৯৬: ভুলে যাওয়া এক অভিশপ্ত দিন

ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া:ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া:
প্রকাশিত: ৩:৫৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৩১, ২০২৩

সংগৃহীত ছবি-

আজ ৩১ জানুয়ারি জগন্নাথ হলের সাম্প্রদায়িক হামলার ২৭ বছর। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সংঘটিত আরও একটি কলঙ্কিত দিন। ঘটনাবহুল অনেক সালতামামির কাছে ভুলে যাওয়া এক অভিশপ্ত দিন— স্বাধীন বাংলাদেশের এক নিকষ-কালো ইতিহাস।

১৯৯৬ সালের এই দিনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাবেক মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতিন চৌধুরীর সরাসরি নির্দেশে প্রায় ৭০০ পুলিশ আর বিডিআর জওয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের নিরীহ ছাত্রদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। এই ঘটনায় আহত হয় দুই শতাধিক ছাত্র-শিক্ষক এবং গ্রেপ্তার করা হয় শতাধিক ছাত্র ও কর্মচারীকে।

আহতদের অনেকেই পঙ্গুত্বের শিকার হন। সেদিনের দৈনিক ইত্তেফাকের বিবরণ অনুযায়ী, “নজিরবিহীন এই সশস্ত্র হামলায় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এক অকল্পনীয় অমানবিক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পুলিশ গেট ভাঙ্গিয়া জগন্নাথ হলে প্রবেশ করিয়া প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালায় এবং রাইফেলের বাট ও বুটের আঘাতে ছাত্রদের রক্তাক্ত করিয়া ফেলে। মধ্য যুগীয় কায়দায় পুলিশের এই বর্বরোচিত হামলার দৃশ্য যাহারা দেখিয়াছে, তাহারাই শিহরিত হইয়া উঠিয়াছেন। উপস্থিত সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান ইহা পাকবাহিনীর নির্যাতনকেও ছাড়িয়া গিয়াছে।”

তৎকালীন অবৈধ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা উদ্বোধন করতে আসার কথা। তখন বিএনপি সরকারের চরম দুঃশাসনের কারণে ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায় খালেদা জিয়াকে যে কোন মূল্যে প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বিশাল মিছিল বাংলা একাডেমির মূল ফটকে যাওয়া মাত্র শত শত পুলিশ গুলি, লাঠি চার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের নির্বিচারে বেধড়কভাবে পেটাতে পেটাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে নিয়ে আসে।

এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পলাশী, শামসুন্নাহার হল ও শহীদ মিনার চত্বরের দিক থেকে পুলিশ জগন্নাথ হলের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। দুপুরের পর জগন্নাথ হলে শুরু হয় পুলিশের নির্মম অ্যাকশন। ৩ ঘণ্টা ধরে পুলিশ জগন্নাথ হলের প্রতিটি রুম এবং হল ক্যান্টিনে গিয়ে বিনা উস্কানিতে ছাত্রদের বেদম প্রহার শুরু করে। এমনকি যে সকল সাধারণ ছাত্ররা পড়ালেখায় ব্যস্ত ছিল ও দুপুরের খাবার গ্রহণ করছিল, তারাও পুলিশের নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি। পুলিশ হলের ডাইনিং রুমে ঢুকে লাথি দিয়ে ভাত ও ডালের গামলা ফেলে দেয়। জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্রকে কম্বল জড়িয়ে দম বন্ধ অবস্থায় বেদম প্রহার করে, চ্যাংদোলা করে রুম থেকে বারান্দায় ফেলে দেয়।

এই হামলার সবচেয়ে বীভৎস দিক ছিল পুলিশ বাহিনীর অশ্রাব্য ও সাম্প্রদায়িক গালিগালাজ। যা অতীতের সকল হামলার নৃশংসতাকে ম্লান করে দেয়। এমনকি কোনো কোনো ছাত্রদের রুমে রক্ষিত দেব-দেবীর ছবি ও প্রতিমাও রক্ষা পায়নি। সেদিন দেশি-বিদেশি সকল গণমাধ্যমে এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ শিরোনাম হিসেবে ছবিসহ প্রকাশিত হয়। ঘটনার প্রতিবাদে জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরগণ একযোগে পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে আক্রমণ করে।

Nagad

ঘটনার পর পর হাসপাতালে আহতদের দেখতে ছুটে যান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং তিনি আহতদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। দেশের প্রায় সকল জাতীয় দৈনিকে সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “জগন্নাথ হলের ছাত্রদের ওপর এই হামলা পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়”, “শিক্ষাঙ্গনে এই রক্তপাত জাতির বিবেককে আঘাত হানিয়াছে, এ জন্য খালেদা জিয়াকে ইতিহাস ক্ষমা করিবে না।”

ঘটনার দুই দিন পর ৩রা ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে পালিত হয় সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ। এ হামলা ছিল মূলত তৎকালীন বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রপরিচালনায় সাম্প্রদায়িক নীতির প্রতিফলন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সম্প্রদায়সহ নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত আবাসিক হল। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে এই হলেই পাক-হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ-লাইট’র শুরুতেই জগন্নাথ হলের ঘুমন্ত ছাত্র-শিক্ষকদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর স্বাধীন বাংলাদেশে জগন্নাথ হল বারবার সাম্প্রদায়িক সরকারের হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি দৈনিক ভোরের কাগজে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক আবেদ খান “মন জয় করার বদলে যুদ্ধ জয় করলেন প্রধানমন্ত্রী” শিরোনামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন, “১৯৭৫ সালের আগস্টের পর থেকে ২১ বছরে জগন্নাথ হলের ওপর পুলিশ ও সরকারের পেটোয়াবাহিনীর হামলা হয়েছে কমপক্ষে ৫০ বার।”

১৯৯৬ সালের ৩১ জানুয়ারি নৃশংস এই হামলার সময়ে আমি জগন্নাথ হলের একজন আবাসিক ছাত্র। ঘটনার দিন দুই দুইবার পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন ৩২নং ওয়ার্ডে সপ্তাহ খানেক চিকিৎসাধীন ছিলাম। সেদিন বিএনপির মতো একটি সাম্প্রদায়িক সরকারের নির্মম আক্রোশ আমি স্বচক্ষে দেখেছি। ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ দৈনিক সংবাদে সুলতান নাহার লিখেছিলেন তৎকালীন বিএনপি সরকারের সুপরিকল্পিত নির্মম পুলিশি হামলা নৃশংসতা ও ব্যাপকতায় কেবলমাত্র পাকিস্তানি বাহিনীর হামলারই তুল্য। একটি স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক(!) সরকারের অধীনে এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা কোনো সুস্থ মানুষ বা সভ্যসমাজ মেনে নিতে পারে না। ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী কলম ধরলেন এবং লিখলেন “এ কোন বাংলাদেশ?”।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরেও বিএনপি-জামায়াত অপশক্তির এই ধরনের সংঘটিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত বর্বর হামলা বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে। নৌকায় ভোট দেওয়ার অপরাধে সারাদেশে বিএনপি- জামাতের মন্ত্রী-এমপিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে তাদের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠেছিল। সেই হামলার প্রধান টার্গেট ছিল দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

আজ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় অসাম্প্রদায়িক নীতি বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরামহীন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির ধারায় এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়— বাংলাদেশ যেন আর সেই উগ্র-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার না হয়। আমরা যেন আর ফিরে না যায় সেই দুঃসময়ের নির্মম অভিঘাতে। সূত্র: সমকাল

লেখক : ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।