শ্রীলংকায় এখন কাঁঠাল খেয়েই বেঁচে আছে লাখ লাখ মানুষ

সারাদিন ডেস্কসারাদিন ডেস্ক
প্রকাশিত: ৩:২৩ অপরাহ্ণ, জুলাই ৯, ২০২৩

ছবি- সংগৃহীত

এক বছর আগে নয়ই জুলাই নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিক্ষুব্ধ জনতার রোষের মুখে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসা ক্ষমতাচ্যূত হবার পর দেশটি এখন দারিদ্রে ধুঁকছে। খাবার জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির বড় একটা জন গোষ্ঠি।

“কাঁঠাল খেয়ে আমরা লাখ লাখ মানুষ প্রাণে বেঁচে আছি। অনাহারের হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে এই কাঁঠাল,” বলছিলেন দিন মজুর তিন সন্তানের পিতা কারুপ্পাইয়া কুমার।

একসময় ফল হিসাবে সবচেয়ে অবজ্ঞা করা হতো যে কাঁঠালকে সেটাই এখন মানুষের প্রাণ রক্ষাকারী আহার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৫ কেজি কাঁঠাল পাওয়া যায় প্রায় এক ডলার সমমূল্যে।

“অর্থনৈতিক সঙ্কটের আগে প্রতিটি মানুষের ভাত বা পাউরুটি কেনার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু এখন খাবারের দাম এতটাই নাগালের বাইরে চলে গেছে যে বহু মানুষ প্রায় প্রতিদিন কাঁঠাল খেয়ে আছে,” বলছিলেন ৪০ বছর বয়সী কুমার।

শ্রীলংকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে রয়েছে। এখন প্রতি দুটি পরিবারের মধ্যে একটিকে বাধ্য হয়ে তাদের আয়ের ৭০% এর বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে খাবারদাবারের ওপর।

“আগে আমরা তিন বেলা খেতাম। এখন খাচ্ছি দুবেলা। ১২ কেজি ওজনের রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম গত বছর পর্যন্ত ছিল ৫ ডলার,” বলছিলেন তিন সন্তানের মা নাদিকা পেরেরা।

Nagad

“সিলিন্ডারের দাম এখন দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে। ফলে এখন বাধ্য হয়ে পুরনো পদ্ধতিতে চুলা জ্বালিয়ে রাঁধতে হচ্ছে,” চোখ মুছতে মুছতে বলছিলেন তিনি। নারকেলের খোলা দিয়ে চুলায় আগুন জ্বালাচ্ছিলেন তিনি- চোখ জ্বালা করা বিষাক্ত ধোঁয়া তার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে।

শ্রীলংকা তার ইতিহাসে নজিরবিহীন সবচেয়ে গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত হয় ২০২২ সালে। দেশটির অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় এর পর থেকে মানুষের আয় সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে এবং খাদ্যদ্রব্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে।

সঙ্কটে বিপর্যস্ত দেশটিতে বিরামহীন বিদ্যুতের অভাব আর জ্বালানির মজুত ফুরিয়ে আসার পটভূমিতে যে তীব্র জনরোষ সৃষ্টি হয়েছিল তার জেরে জনগণ প্রেসিডেন্ট গোটাাবায়া রাজাপাকসার সরকারি বাসভবনে চড়াও হয় গত বছর ৯ জুলাই। এরপর দেশ ছেড়ে পালান রাজাপাকসা।

এরপর দেশটির সরকার দেনদরবার করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে ঋণ জোগাড় করতে সমর্থ হলেও দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে দারিদ্র দ্বিগুণ বেড়েছে।

স্বামী ও সন্তান নিয়ে নাদিকা থাকেন রাজধানী কলম্বোর ছোট একটি ফ্ল্যাটবাড়িতে। সেখানে শোবার ঘর মাত্র দুখানা।

নাদিকা জাতীয় ক্যারাম চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী সাবেক প্রতিযোগী। কিন্তু তিনি অর্থের অভাবে রয়েছেন। ক্যারাম এশিয়ার জনপ্রিয় একটি খেলা।

কিন্তু ক্যারাম খেলায় রেফারি হয়ে তিনি যে অর্থ উর্পাজন করতেন তা এখন বন্ধ। তার স্বামী এখন জীবিকার তাগিদে ভাড়ার ট্যাক্সি চালান।

“মাংস বা ডিম কেনার সঙ্গতি এখন আর আমাদের নেই। এসবের দাম বেড়ে গেছে ছয় গুণ। বাস ভাড়া এতটাই বেড়েছে যে আমরা প্রতিদিন বাচ্চাদের বাস ভাড়া জোগাতে পারছি না। ফলে প্রায়ই তাদের স্কুল কামাই করতে হচ্ছে। আমি প্রার্থনা করি যেন এক দিন রান্নার গ্যাস আর বিদ্যুতের বিল কমে আমাদের নাগালের মধ্যে আসে,” বলেন নাদিকা।

মুদ্রাস্ফীতি জুন মাসে ১২%এ নেমেছে- ফেব্রুয়ারি মাসে তা ছিল ৫৪%। তার পরেও পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় মূল্যবৃদ্ধি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।

বিপর্যস্ত গ্রামীণ অর্থনীতি ও জনজীবন

রবার আর চা বাগানের সবুজে ঢাকা পাহাড়গুলোর মাঝখানে রত্নাপুরা শহর, কলম্বোর প্রায় ১০০ মাইল (১৬০ কিমি) দক্ষিণে।

কারুপ্পাইয়া কুমার জীবিকার তাগিদে নারিকেল গাছে উঠে নারিকেল পাড়েন। প্রতিবার ওঠায় তার আয় হয় ২০০ শ্রীলংকান রুপিা (৬৫ সেন্টের সম পরিমাণ)।

“জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচও টানতে হয়। কাজেই খাবার কেনার জন্য খুবই কম পয়সা হাতে থাকে,” তিনি বলেন।

কারুপ্পাইয়ার স্ত্রী রবার চাষের কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন। রবার গাছের কাণ্ডে খাঁজ কাটার কাজ করেন তিনি, যেখান থেকে বেরিয়ে আসা রবার সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু বর্ষার মরশুমে সে কাজ এখন বন্ধ।

“বৃষ্টি হলেও ঘরে বসে থাকার উপায় আমার নেই। বৃষ্টির মধ্যেই আমাকে নারিকেল গাছে উঠে নারিকেল পাড়তে হয়। পরিবারের ভরনপোষণ তো করতে হবে,” বলেন মি. কুমার, যিনি এই কাজের ঝুঁকি সম্পর্কে পুরো ওয়াাকিবহাল।

দক্ষিণাঞ্চলে পাশেই বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি এলাকা পালেন্দা। সেখানে বাস করেন প্রায় দেড়শ’টি পরিবার। তাদের প্রায় সবাই কৃষক ও শ্রমজীবী।

স্থানীয় সরকারি স্কুলে দেখলাম প্রিন্সিপাল ও কয়েকজন শিক্ষক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ওজন নিচ্ছেন এবং খাতায় তা নোট করছেন।

“বেশিরভাগ বাচ্চাদের পরিবারই গত বছর দারিদ্রসীমার নিচে গিয়ে পৌঁছেছে। কাজেই আমরা এসব পরিবারের শিশুদের স্কুলের জন্য বরাদ্দ কিছু খাবার দিতে শুরু করেছি। আগে স্কুলের খাবারে সপ্তাহে দুটো করে ডিম দেয়ার রেওয়াজ ছিল,” জানান স্কুলের প্রিন্সিপাল ওয়াজির জহির।

“এখন খাদ্য পণ্যের দাম এত বেড়েছে যে সপ্তাহে আমরা একটা করে ডিম দিচ্ছি। কিছু প্রোটিন তো লাগবেই।” তিনি বলেন, প্রায় অর্ধেক শিশুর ওজন বয়স আন্দাজে কম এবং তারা অপুষ্টির শিকার।

এক বছরের ওপর অর্থনৈতিক কঠিন অবস্থা চলার কারণে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। দেশটির দুই কোটি বিশ লক্ষ মানুষের বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার কথা।

শ্রীলংকা প্রায় ৮৫% ওষুধ বাইরে থেকে আমদানি করে। কাজেই অর্থনৈতিক সঙ্কট যখন শুরু হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ে ঘাটতি তৈরি হয়, তখন থেকে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধপত্রের ব্যাপক অভাব দেখা দিয়েছে।

শৈল শহর ক্যান্ডির শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক মোয়া ডি জয়সা পরিস্থিতির একজন প্রত্যক্ষ শিকার। তার ফুসফুসের ফাইব্রোসিসের চিকিৎসার জন্য ভারত থেকে ওষুধ আনতে তাকে রীতিমত বেগ পেতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত নয় মাস আগে তিনি মারা যান।

“ওষুধ আনাতে অনবরত যে ধরনের বিলম্বের শিকার তাকে হতে হচ্ছিল তা নিয়ে রীতিমত হতাশ ছিলেন তিনি, কিন্তু তার বই লেখার কাজ তিনি থামাননি। তিনি জানতেন তার মৃত্যু আসন্ন কারণ ওষুধ ছাড়া এই রোগ থেকে সেরে ওঠা সহজ নয়,” বলেন তার স্ত্রী মালিনী ডি জয়সা।

“অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে তার শেষের মাসগুলো আমাদের জন্য কিছুটা চাপমুক্ত হতে পারত। আমরা বিশাল দেনা শোধ করতে গিয়ে পরে হিমশিম খেয়েছি।”

কলম্বোর একটি মাত্র বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতালের ভেতরেও দুঃসহ পরিস্থিতির চিত্র পরিষ্কার।

হাসপাতালের ভেতরের ক্লিনিকের বাইরে বসেছিলেন ৪৮ বছর বয়সী স্তন ক্যান্সারের রোগী রামানি অশোকা। তার দ্বিতীয় দফার কেমোথেরাপি শুরু হবার কথা আগামী সপ্তাহে। তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন তার স্বামী।

“এই হাসপাতালে আসতে এমনিতেই প্রচুর খরচ হয়, যদিও এখন পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে বিনা মূল্যেই ওষুধ দেয়া হচ্ছিল। এখন কোন একটা ফার্মেসি থেকে আমাদের ওষুধ কিনতে হবে, কারণ কোন ওষুধের দোকানের স্টকে ওষুধ নেই,” বললেন রামানি অশোকা।

শ্রীলংকার স্বাস্থ্য মন্ত্রী কেহেলিয়া রাম্বুওয়েলা ইতোমধ্যেই মানুষজনকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে চড়া দাম এবং ঘাটতি থেকে “অবিলম্বে পুরো পরিত্রাণের সম্ভাবনা নেই”।

“ভেবে দেখুন- আমাদের যে স্বল্প পরিমাণ সঞ্চিত মুদ্রা আছে তা দিয়ে আমরা কী আমদানি করব সেই কঠিন সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হচ্ছে – খাদ্যদ্রব্য নাকি ওষুধ? অনাহারে থাকার সঙ্কট এড়াতে আমাদের তো খাবার আমদানি করতে হবে। তবে পায়ের তলায় এখন কিছুটা মাটি তৈরি হয়েছে এবং পরিস্থিতির ক্রমান্বয়ে উন্নতি হবে,” তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন।

কিন্তু সাধারণ মানুষকে তাদের বেঁচে থাকার পথ এখন নিজেদেরই খুঁজে নিতে হচ্ছে। আগে কাঁঠালগুলো “মাঠে পড়েই পচত” বলছিলেন কারুপ্পাইয়া।

তিনি বলেন, “এক পাত্র সেদ্ধ করা কাঁঠাল আমাদের পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে সারাদিন খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট।” তার প্রতিবেশিদের সাথে তিনি একটা অভিনব “চুক্তি” করেছেন কারণ তার জমিতে কোন কাঁঠাল গাছ নেই।

“আমি প্রতিবেশিদের কাঁঠাল গাছে উঠে তাদের জন্য কাঁঠাল পেড়ে দিই- তার জন্য কোন পয়সা নিই না- তারা দিতে চাইলেও নিই না। আমি বরং বিনিময়ে তাদের গাছ থেকে একটা করে কাঁঠাল বাসায় নিয়ে যাই।”

রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তার আস্থা নেই- কিন্তু আস্থা আছে প্রকৃতির ওপর। তিনি বলেন, “কাঁঠাল আর নারকেল গাছগুলোই আমার কাছে বাপমায়ের মত।” তথ্যসূত্র-বিবিসি

সারাদিন/০৯ জুলাই/এমবি