লক্ষ্মী প্যাঁচার কাজিন-কে অবশেষে খুঁজেই পেলাম: ডা. আব্দুস সামাদ আলিম

ডা. আব্দুস সামাদ আলিম (ইমু):ডা. আব্দুস সামাদ আলিম (ইমু):
প্রকাশিত: ২:৫১ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৩, ২০২৩

পাহাড়ি প্যাঁচা: আলোকচিত্রী ডা. আব্দুস সামাদ আলিম (ইমু)

সাংখালাখিরি প্রস্তাবিত ন্যাশনাল পার্কে ছবি তুলতে হেঁটে বেড়াচ্ছি। এর মাঝে বন্ধু ডন ও পার্ক রেঞ্জারের মাঝের আলোচনাতে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। আসলে, কেবল ওই একটা শব্দই বুঝতে পারলাম – bay-owl. আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলাম যে, ওরা কি বাংলাদেশের পাখিয়ালদের স্বপ্নের ‘পাহাড়ি প্যাঁচা’ বা, ‘oriental bay-owl’ নিয়ে কথা বলছে কি না! বহু কষ্টে যেটুকু বুঝলাম তার সারমর্ম হলো – ডন এখানে এর আগেও বেশ কয়েকবার পাহাড়ি প্যাঁচা দেখেছে এবং, রেঞ্জার মহোদয়ও কয়েক রাত আগে, পাহাড়ি প্যাঁচার ডাক শুনেছে। এটুকু শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে, রাতে আসতে হবে এখানে।

পাহাড়ি প্যাঁচা বাংলাদেশে আসলেই আছে কি না, এ বিষয়ে কিছুদিন আগে পর্যন্ত যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কিছু আর্টিকেলে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর ময়মনসিংহে, এর দেখা পাওয়ার কথা উল্লেখ করলেও, চাক্ষুষ প্রমাণ মিলছিলো না। কয়েক বছর আগে, একজন স্থানীয় পাহাড়ির হাতে আটক একটি পাহাড়ি প্যাঁচার ছবি, এসব সন্দেহের অবসান ঘটায়।

আসলে লক্ষ্মী প্যাঁচার কাজিন, এই পাহাড়ি প্যাঁচার খোঁজ পাওয়াটা খুব কঠিন । পাহাড়ি এলাকার ঘন জঙ্গলে বসবাসকারী এই প্যাঁচা, খুবই স্ট্রিক্ট রকমের নিশাচর! জঙ্গলে, তার এলাকার আশেপাশে অবশ্যই, নদী-খাল-জলস্রোতের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এরকম জায়গায়, রাতের বেলা পাখি খোঁজার বিষয়টা, বেশ কঠিনই বটে।

আমার অতি আগ্রহের কারণে, সেদিন সন্ধ্যা বেলায়ই রাতের খাবার সহ, বনের ঠিক বাইরে পৌঁছে গেলাম আমরা। যেহেতু রাতের বেলা প্রচুর জিনিসপত্র সাথে নিয়ে ঘোরা যাবে না তাই, প্রথমেই ডিনার শেষ করে, দু’টো টর্চ, একটা হেড ল্যাম্প, ট্রাইপডে সেট করা ক্যামেরা-লেন্স নিয়ে বের হবার সিদ্ধান্ত হলো। দিনে যেখানে ছিলো প্রচণ্ড গরম, সন্ধ্যা বেলায় সেখানে, একটু শীত-শীত লাগছিল। তাই, কাপড়ের উপর একটা উইন্ডব্রেকার চাপিয়ে নিলাম। পাহাড়ি প্যাঁচা দেখার সম্ভাবনা আছে সেই উত্তেজনায়, তেমন কিছু খেতে পারলাম না। আমাদের চালক, আমার না খাওয়া খাবারটুকু, এক কুকুরকে যত্ন করে খাইয়ে দিলো। এতেই ঘটে গেল অঘটন! কৃতজ্ঞ কুকুর, কোনভাবেই আর পিছু ছাড়বে না! সাথে সাথে চলতে লাগলো। আসলে সাথে সাথে নয় বরং, … আগে আগে চলতে লাগল আর, আমাদের প্রটেক্ট করার জন্য, একটু পর-পরই তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করে, অজানা-আদেখা শত্রুদের হাত থেকে, আমাদের রক্ষা করে চললো! তাকে তাড়ানোর সব চেষ্টা বৃথা যাওয়ায়, উপায়ন্তর না পেয়ে, গাড়ির চালককে, তাকে সামলানোর ভার দিয়ে, আমরা এগিয়ে গেলাম বনের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছোট নদীটির উদ্দেশ্যে। কথা হলো, কুকুর-মুক্তি হলে সে নদীর পাড় ধরে হেঁটে, খুঁজে নিবে আমাদের।

ঘুটঘুটে আঁধারে হাঁটাহাঁটি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে, এক জায়গায় বসলাম। বয়ে চলা নদী আর, ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ ছাড়া, আর কোন শব্দ নেই; নেই কোন রাত জাগা পাখির ডাক। রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেল! গাড়ি চালক ইতোমধ্যে যোগ দিয়েছে আমাদের সাথে। রাত দশটার দিকে, নদীর ওপার থেকে প্রথম ডাক শোনা গেল oriental bay-owl এর। ডাক এর দিকে, টর্চের আলো ফেলে ঘন জঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখা গেল না! পনরো মিনিট ধরে একটানা ডাক ফলো করে, খুঁজে গেলাম পাখিটিকে। কিন্তু, দেখা মিললো না।

একটু একটু করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে এর মধ্যে। হতাশ হয়ে সবকিছু গুটিয়ে, ফিরে চললাম গাড়ির দিকে।

Nagad

জঙ্গল থেকে বের হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে, হঠাৎ মনে হলো, খুব কাছ থেকে ডেকে উঠলো পাখিটা। শেষ চেষ্টা হিসেবে, ঢুকে পড়লাম জঙ্গলের ভেতরে। কাদাটে মাটির উপর দিয়ে, কাঁটা ঝোপগুলো এড়িয়ে ঢুকতে থাকলাম জঙ্গলের গভীরে। কিছুই দেখা যায় না! কেবল ডাকের দিক লক্ষ্য করে হেঁটে চলা। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর, বিশ্রামের জন্য দাঁড়ালাম। হঠাৎ মনে হল, সামনের বাঁকের পরের জায়গা থেকে ডেকে উঠলো পাখিটা! পা টিপে টিপে পাঁচ মিনিট হাঁটার পর, জঙ্গলের ভেতরে একটা খোলা মতো জায়গায় এসে পড়লাম! টর্চ জ্বালিয়ে, চারদিকে আলো ফেলে খুঁজতে লাগলাম। একসময়, একটা গাছের মধ্যে চোখে পড়লো তাকে! যেন, অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকেই!

আমিও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে! টর্চটা ডনের হাতে দিয়ে, ক্যামেরা-ট্রাইপড যেমন আছে তেমন অবস্থায়-ই 1/50 শাটার স্পিডে, কয়েকটা শট নিলাম। এমন সময় ভয়ঙ্কর জোরে বজ্রপাত! সম্বিত ফিরে চমকে উঠে, উড়ে গেল পাহাড়ি প্যাঁচা! সাথে সাথেই নামলো ঝুম বৃষ্টি! আমি লেন্স-ক্যামেরা উইন্ডব্রেকারে পেঁচিয়ে, টর্চ সহ সেটিকে চালকের হাতে দিয়ে ইশারায় তাকে বের হয়ে যেতে বললাম। ডন এর মধ্যে আরেকটি টর্চ নিয়ে দিয়েছে ছুট! আমিও হেডল্যাম্পের আলোয় পথ দেখে দেখে ছুটতে লাগলাম! কিছুদূর ছোটার পর বুঝলাম, পথ হারিয়েছি!

বৃষ্টিতে তখন ভিজে একসা! বুঝলাম, মাথা গরম করে লাভ নেই; দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ক্যালকুলেশন করতে থাকলাম কোন দিকে এগোলে, জঙ্গল থেকে বের হওয়া যাবে। হিসেব কষে, কাঁটা-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, একদিকে হাঁটা দিলাম … । ভিজতে ভিজতে আর, কাঁটার খোঁচা খেতে খেতে একসময় দেখি – জঙ্গল শেষ! বের হয়ে এসে, এবার রাস্তা আর, গাড়ি খোঁজার পালা! সেটাও মিলে গেল একসময়!

গাড়ির চালক সবকিছু গুছিয়ে, টাওয়েল হাতে গাড়ির ভেতর বসে আছে আমার জন্য। কিন্তু, ডন ফেরত আসেনি তখনো। সিটে বসে কাপড় বদলে, গা মুছতে মুছতে অপেক্ষা করতে থাকলাম, ওর জন্য। মিনিট পনরো পর, ফেরত আসার পর জানালো, পথ হারিয়েছিলো সে ও। জানতে চাইলো, আমি কোন ছবি তুলতে পেরেছি কি না! বললাম, ছবি তুলতে পেরেছি কি না, সেটা চেক করার মতো অবস্থা নেই। তবে, খুব ভাল করে দেখে নিয়েছি এটা বলতে পারি।

এরপর, সেই ভয়ানক বৃষ্টির মধ্যে, পিচ্ছিল পাহাড়ি মাটির তথাকথিত রাস্তা বেয়ে ফেরার গল্প, সেটি ছিল আরেক অভিযান! তবে, আজ আর সেটি বলছি না! এমনিতেই, অনেক বড় হয়ে গেছে লেখাটা! কেবল যে ছবিগুলো তুলেছিলাম, তার একটি শেয়ার করি:

পাহাড়ি প্যাঁচা-Oriental bay-owl-Phodilus badius.

লেখক: আলোকচিত্রী ডা. আব্দুস সামাদ আলিম (ইমু) ।