উধাও এমটিএফই, সর্বস্ব খোয়ানোর পরে নি:স্ব গ্রাহকরা
আবারও প্রতারণা শিকার বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা। এমএলএম কোম্পানির প্রতারণায় জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হলো দেশের লক্ষাধিক তরুণ সমাজ। হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে অবৈধ অনলাইন গ্যাম্বলিং ক্রিপ্টো ট্রেডিং করা এমএলএম কোম্পানি এমটিএফই। শুধু দেশেই নয়- ভারতেও তারা প্রতারণার জাল বিছায়। এই প্রতারণার জালে পা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন সেখানকার বহু মানুষ। জানা গেছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ছত্রিশগড়, মহারাষ্ট্র আসাম সহ বহু রাজ্যে জাল বিছিয়ে ছিল সংস্থাটি। বাংলাদেশের গ্রামের তরুণ সহ বিনিয়োগকারীরা বেশি বিপাকে পড়েছে।
তবে-দেশে মোট কতজন এ স্কিমের প্রতারণা শিকার হয়েছেন তার কোনো স্পষ্ট তথ্য নেই। তবে গ্রাহকদের বিভিন্ন দলের নেতারা অনুমান করছেন, এ সংখ্যা এক থেকে পাঁচ লাখ হতে পারে। তাদের ধারণা, এ স্ক্যামে প্রায় হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন দেশের বিনিয়োগকারীরা।
জানা গেছে-দুবাইভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পঞ্জি মডেলে ব্যবসা করতো। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিনিয়োগকারী ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এরকম একজন দলনেতা বলেন, ‘রেফারেলের কারণে গত চার-পাঁচ মাসে অ্যাপটির ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। এখন যা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি।’
এমএফটিই দাবি করেছিল, তারা কানাডায় নিবন্ধিত সংস্থা। এর কার্যক্রম শ্রীলঙ্কা, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও ভারতেও ছড়িয়েছিল। এসব দেশের ব্যবহারকারীদেরও ভাগ্যেও একই পরিণতি হয়েছে।
ক্রিপ্টো, বৈদেশিক মুদ্রা, পণ্য, এমনকি বিদেশি স্টক পর্যন্ত নিজের ছায়া প্ল্যাটফর্মে ট্রেড করার সুযোগ দিয়ে এ অ্যাপটি সম্প্রতি অবিশ্বাস্যরকমের জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
ট্রেডিং থেকে উপার্জন এবং অর্থ পরিশোধের কথা বলে অ্যাপটি ব্যবহারকারীদেরকে অবিশ্বাস্য সহজপথে অর্থ আয়ের আমন্ত্রণ জানায়।
একজন সিইও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৯৩০ ডলার বা ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে মাসে ৪৫ হাজার টাকা লাভ দিতো কোম্পানি। ৫০০ ডলার বা ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে ২২ হাজার টাকা লাভ দিতো। এছাড়া কেউ যদি ৩ হাজার ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করে এবং ১৫ জন ব্যক্তিকে কোম্পানিতে যুক্ত করে আর এই ১৫ জন মিলে যদি ৯ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে তাহলে ৩ হাজার ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করা ব্যক্তি প্রতি মাসে অন্তত ৪ লাখ টাকা করে লাভ পেয়ে থাকে। এভাবেই শত শত যুবককে কোটিপতি বানিয়েছে এই কোম্পানি। তবে হঠাৎ করে কোম্পানিটি উধাও হয়ে যাবে তিনি তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। যদিও গত ১৫ দিন যাবত টেকনিক্যাল প্রব্লেম বলে এই কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কমিশন বন্ধ রেখেছিল। এখানে যারা টাকা দিচ্ছিলেন তারা আর টাকা উঠাতে পারছিলেন না। বৃহস্পতিবার থেকে আর কোনও লেনদেন হচ্ছে না। শুক্রবার পুরোপুরিভাবে এমটিএফই তাদের সিস্টেম বন্ধ করে দিয়েছে।
কমপক্ষে ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে দিন শেষে পাঁচ হাজার টাকা লাভ আসবে। এই কল্পিত মুনাফার লোভে শত শত মানুষ বিনিয়োগ করেছিলেন। অনেকে গয়না এবং মূল্যবান সামগ্রী বন্ধক রেখেও বিনিয়োগ করেছিলেন। আর এভাবেই হয় প্রতারণরা শিকার।
যেভাবে উদাও
এমটিএফই গত ৭ই আগস্ট থেকে টেকনিক্যাল সমস্যা দেখিয়ে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন সেবা বন্ধ করে দেয়। এদিন রাত ১২টার পরে ট্রেডিংয়ের নামে সকলের অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেয়া হয়। উল্টো গ্রাহকদের মূলধনের অর্থের সমপরিমাণ ডলার মাইনাস করে দেখানো হয়। এবং তাদের অ্যাপে জরুরি নোটিশ জারি করা হয়।
নোটিশে বলা হয়, গ্রাহকরা এমটিএফই সেবা চলমান রাখতে হলে তাদের মাইনাস ব্যালেন্স পরিশোধ করে আবার ডলার ডিপোজিট করুন। এমনকি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এমটিএফই’র প্রাপ্ত মাইনাস ডলার পরিশোধ না করলে গ্রাহকদের আইনি নোটিশ পাঠানোর হুমকি দেয়া হয়।
শুধু বাংলাদেশই নয় এমটিএফই তাদের কার্যক্রম পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়। কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, মালেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া, ইসরাইল, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান, কেনিয়া, তানজেনিয়া, রুয়ান্ডা, কঙ্গো, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ওমান, আইভোরিকোস্ট, ইরাক, ইয়েমেন ও জিবুতিতে তারা প্রতারণা করে প্রায় ৭ কোটি মানুষের কাছ থেকে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার নিয়ে উধাও হয়েছে।
কিভাবে গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে
গুগল প্লে স্টোরে পাওয়া যায় এমটিএফই অ্যাপটি। যাতে খুব সহজেই মানুষ লোভে পড়ে ডাউনলোড করে। গ্রাহকদের সিমুলেশন প্ল্যাটফর্মে ট্রেডিং চর্চা করতে বলে অ্যাপটি। ট্রেডিংয়ের এ চর্চার সময় লাভ-ক্ষতি যা-ই হোক, তার মালিকানা থাকে ব্যবহারকারীর কাছে। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ এমটিএফই অ্যাপে অন্তত ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন।
বাংলাদেশে বিদেশি সম্পদে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। এ কারণেই এমটিএফই ব্যবহারকারীদেরকে প্রথমে গ্রে মার্কেট ব্যবহার করে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনতে হয়। তারপর তারা প্ল্যাটফর্মটিকে অর্থ দেন।
আবার অ্যাপটি থেকে ব্যবহারকারীদেরকেও ক্রিপ্টো মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ করা হয়। ওই ক্রিপ্টো বাংলাদেশি এমটিএফই ব্যবহারকারীরা প্রথমে ডলারে, তারপর স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তর করেন।