তারকা ও হাজারো নারীর মিলন মেলায় পরিণত ‘উই সামিট’

তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিবেদক:তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিবেদক:
প্রকাশিত: ৬:০৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৭, ২০২৩

সারা দেশ থেকে আসা হাজারো নারীর পদচারণায় এক উদ‌্যোক্তা মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে দুই দিনের উই সামিট ২০২৩। শুক্রবার (৬ অক্টোবর) সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলার নারীরা আসতে শুরু করেন ভেন‌্যুতে। রাজধানীর কুড়িলের আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টার বসুন্ধরায় দুই দিনের উই সামিট শুক্রবার সকালেই মুখরিত হয়ে ওঠে প্রান্তিক ও শহুরে সব উদ‌্যোক্তা এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনের তারকাদের অংশগ্রহণে।

সকাল ১০টায় শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উদ্বোধনের পর থেকেই অনুপ্রেরণামূলক বক্তব‌্য, উদ্যোক্তাদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আয়োজিত প‌্যানেল আলোচনা ও কর্মশালা ছিল প্রাণবন্ত। হাজার হাজার নারী উদ‌্যোক্তা এসব সেশনে নিজেরে পাথেয় খুঁজে পান।

উদ্বোধনের পরপরই শুরু হয় জনপ্রিয় মোটিভেশনাল বক্তা ডন সামদানি ফ্যাসিলিটেশন অ‌্যান্ড কনসালটেন্সসের চিফ ইন্সপিরেসনাল অফিসার গোলাম সামদানি ডন। তিনি বলেন, নারী বলে নিজেদের কখনো ছোট করে দেখবেন না। আপনি যেটাতে ভালো সেখানে বিশ্বের সেরা কীভাবে হওয়া যায়, সেটা নিয়ে এগিয়ে যান। আপনাদের একটি এরিয়া খুঁজে বের করতে হবে, যার আশেপাশে কেউ থাকবে না। আপনাকে ফলো করবে সবাই। মনে রাখবেন নারী পুরুষ সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বে।

ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স সুবিধা নিয়ে প‌্যানেল আলোচনা
ক্রস বর্ডার ই-কমার্স সুবিধা পারে নারী উদ্যোক্তাদের বিশ্ব বাজারে পৌঁছে দিতে। এজন‌্য আয়োজনের প্রথমেই ছিল এ নিয়ে একটি প‌্যানেল আলোচনা। ‘বর্ডারলেস বিজনেস : স্ট্রাটেজিস ফর ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স, লজিস্টিকস অ‌্যান্ড এক্সপোর্টিং’ প্যানেল ডিসকাশন অনুষ্ঠিত হয়। উই-এর উপদেষ্টা কবির সাকিবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইপিবি’র মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান। আরও উপস্থিত ছিলেন আইস্যোসাল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনন‌্য রায়হান, দারাজ বাংলাদেশের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এএইচএম হাসিনুল কুদ্দুস রুশো এবং মার্কিন দূতাবাসের অর্থনৈতিক কর্মকর্তা জেমস গর্ডেনার।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাহবুবুর রহমান বলেন, অনলাইন ব্যবসায় শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববাজার সকলের জন্যই উন্মুক্ত হয়ে গেছে। আমাদের জন্যও ব্যবসায়ের একটি অবারিত দুয়ার খুলে গেছে। এর ফলে নারীর ক্ষমতায়নের পথও প্রশস্ত হয়েছে। এখন ঘরে বসেই হাতে তৈরি পণ্য বিভিন্ন ধরনের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আমেরিকায় বিক্রি করা যাচ্ছে। আবার ইউরোপ বা যুক্তরাজ্যের প্রবাসীরা স্থানীয় অনলাইন থেকে আত্মীয়-স্বজনদের জন্য পণ্য কিনে দিতে পারছেন। এটা আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ। তাই এখনই আমাদেরকে ক্রস বর্ডার ই-কমার্স বিষয়ে শেখার বিষয়ে মনযোগী হতে হবে। কেননা বিশ্ববাজার সেদিকেই যাচ্ছে।

ই-কমার্সে নারীদের উন্নয়নে জন্য ই-ক্যাবের পাশাপাশি উই-এর উচিত এই সেক্টর নিয়ে কাজ করা। এতে করে নারীদের পণ্যে সহজেই বিশ্বের কাছে তুলে ধরা সম্ভব বলে মনে করেন আইস্যোসাল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনন‌্য রায়হান।

Nagad

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তারা যেন অনলাইনে তাদের পণ্য বিপণন করতে পারেন সেজন্য সহজ ও নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও ওয়্যার হাউস সাপোর্টের পাশাপাশি পলিসি এবং পেমেন্টের সহজীকরণই পারে ক্রস-বর্ডার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, এমনটাই মনে করেন প্যানেল বক্তারা।

লার্নস ওয়েলের মাস্টার ক্লাস

প‌্যানেল আলোচনার পর শুরু হয় একটি মাস্টারক্লাস কর্মশালা। কর্মশালা পরিচালনা করেন লার্নস ওয়েলের বাংলাদেশের কর্মকর্তা আদিলা সাঈদ। তিনি বলেন, এখন অনলাইনে ব‌্যবসা করতে গেলে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হয় সেটি হলো সাইবার সিকিউরিটি। সাইবার সিকিউরিটিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করে তাদের প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লার্নস ওয়েল। বাংলাদেশ থেকে উদ্যোক্তারা সে সেবা সহজেই নিয়ে নিজেদের ব্যবসাকে বাড়াতে পারবেন।

নারীর হাইজিন
এরপর নারীদের হাইজিন নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক কথা বলেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মণিকা রহমান। তিনি নারীদের মেনস্ট্রুশেন থেকে অন্য সব শারিরীক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি কিশোরী ও নারীদের হাইজিন যথাযথভাবে মেনে চলার অনুরোধ জানান।

‘এমপাওয়ার থ্রু ইন্সপিরেশন: নার্সিং দ্য অন্ট্রাপ্রেনিউর মাইন্ড’ প‌্যানেল আলোচনা
সেই বক্তার পর শুরু হয় ‘এমপাওয়ার দো ইন্সপিরেশন: নার্সি থ্রু অন্ট্রাপ্রেনিউর মাইন্ড’ নামের প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করা হয়। প্যানেল আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন জনপ্রিয় মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুষমা রেজা, লেখক সাদাত রহমানসহ আরও অনেকে। আলোচনায় উদ্যোক্তাদের নানা মানসিক অবস্থার শিকারের কথা তুলে ধরে সেসব থেকে সুরক্ষার উপায় বলে দেয়া হয়।

‘দ্য ফেসবুক ফ্রন্টিয়ার: স্ট্র্যাটেজিস ফর ই-কমার্স গ্রোথ’
বিকেল ৩টা থেকে শুরু হয় আরেকটি প্যানেল আলোচনা। ‘দ্য ফেসবুক ফ্রন্টিয়ার: স্ট্র্যাটেজিস ফর ই-কমার্স গ্রোথ’ আলোচনায় অংশ নেন এসআর ভেঞ্চারের প্রতিষ্ঠাতা ও ইনভেস্টর সায়মা রহমান, ডান ও ব্র্যান্ডস্ট্রিট ডেটার সিইও জারা মাহবুব, এসএসএল কমার্সের সিওও ইফতেখার ইসাহাক, বারকোড গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মনজুরুল হক। প্যানেল আলোচনা সঞ্চালনা করেন ট্রেইনার অথর আলতামিস নাবিল।

ফেসবুক অনলাইন ব‌্যবসার অন‌্যতম একটি মাধ‌্যম। এই মাধ‌্যমে কাজ করতে গিয়ে অনেকে নানা ধরনের অসুবিধায় পড়েন। সেসব বিষয় উঠে আসে এই আলোচনায়। এ ছাড়া এই সময়ে ডেটা, ডেটার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, নতুন ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলেন আলোচকরা।

‘ডিজিটাল ডায়নামো: ইনহ্যান্সিং ডিজিটাল স্কিলস ফর বিজনেস এক্সিলেন্স’
দেশের ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের অন‌্যতম জনপ্রিয় ব‌্যক্তিত্ব দ‌্য ডেইলি স্টারের হেড অব ডিজিটাল তাজদিন হাসান, ওয়ার্ল্ড ব‌্যাংকের প্রাইভেট সেক্টর স্পেশালিস্ট হওসনা ফেরদৗস সুমি, এজ প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্ম সচিব সাখাওয়াত হোসেন। তারা আলোচনা করেন অনলাইন ব‌্যবসায়ের জন‌্য যেসব ডিজিটাল স্কিলস প্রয়োজন সেগুলো নিয়ে। উঠে আসে নারী উদ‌্যোক্তাদের নানা সমস‌্যা ও সম্ভাবনার কথাগুলো।

‘শিল্ডিং দ্য ডিজিটাল রিলেম: ইনসাইট ইনটু ডিজিটাল কানেক্টিভিটি অ্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি’

উই সামিট ২০২৩-এর অন্যতম আয়োজন ছিল ‘শিল্ডিং দ্য ডিজিটাল রিলেম: ইনসাইট ইনটু ডিজিটাল কানেক্টিভিটি অ্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি’ শিরোনামে প্যানেল আলোচনা। এই আলোচনায় অন্যতম বিষয় ছিল সম্প্রতি ফেসবুক থেকে হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু বড় গ্রুপ। এ ছাড়া সাইবার সিকিউরিটির বিষয়গুলোও উঠে আসে আলোচনায়।

সেখানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি বিভাগে এডিসি নাজমুল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল মাধ্যম সুরক্ষা রাখতে বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করছে। বর্তমানে মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কনটেন্টসহ ফেসবুক পেজ হারিয়ে যাচ্ছে। যা একজন ডিজিটাল ব্যবসায়ীর জন্য ক্ষতিকারক। তাই এ বিষয় নিয়ে ফেসবুকের সাথে কথা বলবো। যাতে করে তারা সহজে ব্যবসা করতে পারে। বাংলাদেশ পুলিশের ৫টি ইউনিট সাইবার নিরাপত্তায় কাজ করছে। বর্তমান সময়ে ওটিপি শেয়ারের মাধ্যমে সাইবার হামলার শিকার বেশি হচ্ছে। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

আইসিটি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ২৫ হাজার নারীদের। ৬ মাসের এই প্রশিক্ষণে প্রত্যেককে একটি ল্যাপটপ দেওয়া হবে। বর্তমান সরকার নারীদের ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে আগ্রহী করে তুলতে কাজ করছে।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, নারীদের প্রযুক্তি খাতে আগ্রহী করে তুলতে বিটিআরসি নানা ধরনের পলিসি নিয়ে কাজ করে থাকে। নারীরা যাতে এই সেক্টরে এগিয়ে আসতে পারে তার জন্য শহরের সাথে সাথে গ্রামেও কমদামে ইন্টারনেট পৌঁছে দিয়েছি আমরা। ফেসবুকের কনটেন্ট সমস্যা হয়, প্রায় সময় আমরা এই বিষয় নিয়ে তাদের সাথে কথা বলি। সামনের দিনেও বলব।

এ ছাড়াও আলোচনায় অনলাইনে যোগ দিয়ে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কথা বলেন সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা।

আয়মান সাদিকের সেশন
টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আয়মান সাদিক সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু করেন তার সংক্ষিপ্ত সেশন। এই সেশনে তিনি উই-এর নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ধরনের অনুপ্রেরণার গল্প তুলে ধরেন। এ সময় তিনি উদ্যোক্তাদের জন্য চারটি বিষয় তুলে ধরে সেগুলো নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। প্রথম অপ্রয়োজনীয় কাজ বাদ দেয়া, এরপর প্রয়োজনীয় কাজগুলোকে অটোমেশন করা। সেগুলোকে ডেডিকেট করে তা অন্যদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে এবং সবশেষ নিজেকে এগিয়ে নিতে প্রাধান্য দেয়া। এসব বিষয় মেনে চললে সামনে দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বাধা এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে বলে জানান।

ছিল তারকাদের মিলনমেলাও
উই সামিট ২০২৩ এর প্রথম দিনে ছিল চলচ্চিত্র অঙ্গনের তারকাদের মিলনমেলাও। সারা দেশ থেকে আসা নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র তারকা ও এজে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী অন্তত জলিল। তিনি বলেন, আমি নিজেও একজন ব্যবসায়ী। আজ উই সামিটে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তার সামনে কথা বলছি, এটা অন্য রকম অনুভূতি। এই ছোট অবস্থান থেকেই আপনারাও একসময় দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী হিসেবে উঠে আসবেন বলে আমি প্রত্যাশা করি।

এ ছাড়া দিনের সর্বশেষ প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন আফসান আরা বিন্দু, রুনা খান, জাকিয়া বারী মম, মাসুমা রহমান নাবিলাসহ অন্যরা। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষ হয় একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে।

উই সামিট ২০২৩-এর দ্বিতীয় দিন শনিবার দুপুর ২টায় শুরু হবে দিনের কর্মসূচি। এরপর অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য, কর্মশালা, বিকেল সাড়ে ৪টার থেকে প্যানেল আলোচনা এবং সন্ধ্যায় থাকছে ২০ নারী উদ্যোক্তাকে ‘জয়ী অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান। আর সমাপনী অনুষ্ঠান হবে একটি ফ্যাশন শো’র মাধ্যমে।