কি নেই এমপি রানার হত্যা মামলার মাষ্টারমাইন্ড শাহীনের সেই বাড়ীতে

অজপাড়াগাঁয়ে উঁচু দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা চারপাশ । ঝিনাইদহের কোটচাদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নের এলাঙ্গী গ্রামে কমপক্ষে ৪০ বিঘার উপর বিশাল বাংলো বাড়িটি । এতো সর্বাধুনিক, এতো বিশাল এলাকা জুড়ে বাড়ি জেলায় আর একটিও নেই । বাড়ীর ভিতর ঢুকলেই গা ছমছটম করবে যে কারো । একটি মাত্র ইন-আউট গেট । মানুষ খেকো হিংস্র ৩টি জার্মান শেফার্ড কুকুর রয়েছে এ বাড়ীতে । যারা পরিচিত কাউকে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করেই চলেছে অনবরত । আলিশান বাংলোতে ডুপ্লেক্স বাড়ি, ব্যায়ামগার, সুমিংপুল, গলফ খেলার মাঠসহ রয়েছে শতাধিক সিসি ক্যামেরা ।

বাড়ীতে ঢুকতেই চোখে পড়ে পথের দু-ধারে আম ও বাহারি ফুল গাছ। পাশেই রয়েছে একটি বিশালাকার সুইমিং পুল ও বিরাট এক পুকুর। পাশের ভবনে নিচের তলায় রয়েছে ব্যায়মগার, খাবারের জায়গা। ২য় তলায় রয়েছে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা। দুটি ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) রয়েছে বেশকয়েটি। কর্মচারীদের থাকার জন্য রয়েছে আলাদা কোয়ার্টার। বারবিকিউ পার্টির জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা।

আক্তারুজ্জামান শাহিন সম্পর্কে জানা যায়, কোটচাঁদপুর উপজেলার পৈত্রিক ভিটা এলাঙ্গী গ্রামের আসাদুজ্জামান কাটুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ আক্তারুজ্জামান শাহিন। ১৯৮৫ সালে কোটচাঁদপুর পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি ও কোটচাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৮৭ সালে এইচ.এস.সি পাস করেন। এক বছর বিরতি থেকে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে দুই বছরের কোর্স করেন, সেখান থেকেই জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরির দুই বছর পর সিঙ্গাপুর থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর আমেরিকার (ওপি টিকিট) ফ্রি ভিসা পাওয়ার পর ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে আমেরিকা যান। সেখানেই তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। জাহাজে চাকরি করার সময়কালেই তিনি ঢাকায় বিয়ে করেন। শাহীনের স্ত্রীর নাম কনক ইসলাম। তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা মা-বাবার সঙ্গে আমেরিকায় থাকেন।

আরো জানা যায়, পূর্বে থেকেই পরিবারে কোন অভাব ছিলো না। তারপরও ছোট থেকেই অর্থ উপার্জন করতেন। শাহিন ২০১৭ সালে দেশে এসে এলাঙ্গী মাঠে বাংলো বাড়ির ওই জায়গাতে ইটের ভাটা করেন। তিন বছর ধরে ইট ভাটার ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় ভাটা বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০২১ সালে এসে শুরু করেন বাংলো বাড়ির কাজ। পিতার দেওয়া ও নিজের ক্রয় কৃত ৪০ বিঘার উপর ২০২২ সালের শেষের দিকে বাংলো বাড়ি নির্মাণ কাজ শেষ করেন। ২০২৩ সালে বাংলো বাড়ির উদ্বোধন করেন। তারপর থেকে শুরু হয় নামি দামী ব্যক্তির ওই বাংলোয় আসা যাওয়া।

কোটচাঁদুপর এলাঙ্গী গ্রামের কালু খান বলেন, বাংলোর পাশেই চাষের জমিটা আমার। আগে সেখানে ইটের ভাটা ছিল। দুই বছর হলো এই বাড়িটি করেছে। তারপর থেকেই শাহিন মিয়া এখানে মাঝে মধ্যে আসেন। কিন্তু গ্রামে বা আশপাশের মানুষের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার কিংবা ক্ষতি করেনি। উল্টো গ্রামের কেউ বিপদে পড়ে তার কাছে গেলে অর্থ দিয়ে উপকার করেছেন।

Nagad

বাড়ির গার্ড আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখানে কারা আসা যাওয়া করে সেটা বলতে পারবো না। তবে দিনের বেলাই তেমন কেউ আসতেন না। আর যখন আসে অনেক গাড়ি একসাথে আসে। আমি তো কাউকে চিনি না যার কারণে বলতে পরবো না যে কারা কারা এখানে আসা যাওয়া করেন। তবে এখানে আমি গেট পাহারা দিই, কুকুরকে খেতে দিই এবং তাদের দেখাশোনা করি।

এলাঙ্গী গ্রামের সাইদুর রহমান বলেন, আমরা শাহিন মিয়ার খুবই কম দেখেছি। এখানে বাংলো বাড়ি করার পর গাড়িতে করে মাঝে মধ্যে এখানে আসে তাই দেখি। যতটুকু জানি শাহিন মিয়ার খারাপ কিছু দেখিনি। তবে এখন যেটা শুনছি সেটা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। এই বাগান বাড়িতে বড় বড় দামি গাড়ি আসতে দেখেছি।

এলাঙ্গী ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মোঃ আমিনুর রহমান বলেন, শাহিনরা অনেক পূর্বের বড়লোক মানুষ। শাহিনের বাবার অনেক জায়গা জমি ছিল। তবে শাহিন অনেক দিন ধরে আমেরিকায় থাকতো। এখানো বাংলো বাড়ি করার পর মাঝে মধ্যে আসতে দেখেছি। তবে ওই বাগান বাড়িতে রাতে কি হতো না হতো আমরা কিছুই জানিনা। গ্রামের কেউ ওই বাগান বাড়িতে ঢুকতে পারে না। আমরাও কখনো জানতে চাইনি যে ওই বাড়ির মধ্যে কি আছে না আছে।

আক্তারুজ্জামান শাহিনের বড় ভাই ও কোটচাঁদপুর পৌর মেয়র সহিদুজ্জামান সেলিম বলেন, এমপি আনারুল আজিম আনারের মেয়ে ডরিন খুবই ছোট মানুষ। তার বাবা মারা গেছে, সে কারণে তার অনেক কষ্ট। আমার বাবা হারালে আমিও ডরিনের থেকে বেশি বলতাম। তবে একটি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে এই কেসটি রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত চলছে এ কারণে আমি কোন মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তেই বেরিয়ে আসবে কে জড়িত বা জড়িত না। এবং ডরিন বলবে বলেই পুলিশ আমাকে আটক করবে বিষয়টি এমন নয়। তারাও বিষয়টি তদন্ত প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যদি মনে করে আমকে আটক করবে তাতে আমার কোন সমস্যা নেই।

আরো বলেন, শাহিন আমার ভাই, কিন্তু পারিবারিক ভাবে অনেক আগে থেকেই সে কোন যোগাযোগ করতো না। তবে শাহিন যদি এই হত্যা কাণ্ডের সাথে জড়িত থাকে তাহলে অবশ্যই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা গোয়েন্দা বিভাগ এটাকে তদন্ত করছে। তাদের তদন্তে যদি আমার ভাই দোষী হয় বা অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইনে যে বিচার হয় আমরা মেনে নিব।

তিনি আরো বলেন,শাহিন আমেরিকায় থাকা কালীন দেশে খুব কমই আসতো। যাই আসতো ঢাকাতে তার ভাড়া বাড়িতে থাকতো। এরপর ২০১৭ সালের দিকে মাঠের মধ্যে বাবা আম বাগান করেছিল সে সেই আম বাগান মেরে দিয়ে ইটের ভাটা করলো। তিন বছর ভাটা চালিয়ে লোকসান হওয়ায় ভাটা বন্ধ করে দিয়ে ওই খানে এই বাড়িটা করেছে। সেখানে আমাদের সবার জমি ছিলো। বাবা আমাদের শহর থেকে জমি দিয়েছে, সেই জমির মূল অনুযায়ী মাঠ থেকে শাহিনকে দিয়েছে এতে আমাদের মাঝে কোন ঝামেলা নেই। মাঠের মধ্যে বাড়ি করার পর আমিও ওখানে কয়েকবার গেছি।