১৯ জেলায় রেমালের দীর্ঘ তাণ্ডব, বরগুনায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক:নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রকাশিত: ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ, মে ২৮, ২০২৪

উপকূলে দীর্ঘ সময় তাণ্ডব চলিয়ে ঘূর্ণিঝড় রেমাল এখন শান্ত। কিন্তু তাতে কি; যে ক্ষতি করে গেলো-তা বয়ে বেড়াবে উপকূলের অসহায় মানুষগুলো। ঘরবাড়ি ও সহায়-সম্বল হারিয়ে দিগ্‌ভ্রান্ত মানুষ। কীভাবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবেন, ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কারণ-কারো সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তারপর আবার ঝড়ের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টি। সব মিলিয়ে উপকূলের অর্ধকোটি মানুষের দুই চোখে এখন অমাবস্যা।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বাগেরহাটে ব্যাপক জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসের পানিতে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে লোকালয়। জেলার অন্তত ৩৫ হাজার মৎস্য ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। এছাড়া ঘেরের পাড়েরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

বরগুনায় বন্যায় আক্রান্ত জেলা উপকূলীয় বরগুনায় ইতোমধ্যে প্রায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নতুন করে অনেক এলাকায় বাঁধ ভেঙে বন্যার পানি গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়েছে। অনেক এলাকায় বাঁধ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

নোয়াখালীর উপকূলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় ৩৩ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাঁচ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্তসহ দুই হাজারের বেশি গবাদিপশু ভেসে গেছে। দমকা হাওয়া ও মুষলধারে বৃষ্টির কারণে জেলার বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। দমকা হাওয়ায় গাছপাল ভেঙে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। দেড়লাখ মানুষ পানিবন্দি, ভেসে গেছে হরিণসহ দুই হাজারের বেশি পশু। নদী উত্তাল থাকায় সাত লাখ অধিবাসীর দ্বীপ হাতিয়ার সঙ্গে সবধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে হাজার হাজার লোক হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাট, তমরুদ্দি ঘাট এলাকায় আটকা পড়েছেন।

বরিশালে ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে প্রায় ৩ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। বরিশাল জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়-বরিশাল জেলায় ২৫৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং ২ হাজার ৬৮৫টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া নগরীতে গাছচাপা ও দেয়ালধসে ২ জন এবং মেহেন্দীগঞ্জে সাপের কামড়ে ১ শিশু মৃত্যু হয়। মৃত প্রত্যেকের পরিবারের কাছে ২৫ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া জেলার ৫৪১টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ৷ নগরীসহ জেলার অধিকাংশ জায়গা ঝড় পরবর্তী জলোচ্ছ্বাস এবং জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বিচ্ছিন্ন হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ক্ষতি হয়েছে কৃষি ও মৎস্য সম্পদের।

এ বিষয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমাল আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে। তবে বরিশালের মানুষ সংগ্রামী জীবন যাপনে অভ্যস্থ। তারা আবার ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করেছে। সরকার তাদের পাশে আছে।

Nagad

বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য সুলতানা নাদিরা বলেন, পাথরঘাটায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রীর কাছে জানানো হয়েছে। তিনি শিগগিরই পাথরঘাটা পরিদর্শনে আসবেন। এ ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে সহায়তা করা হবে বলেও জানান তিনি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিব্বুর রহমান সোমবার (২৭মে) ঘূর্ণিঝড়ের প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে জানান, এখন পর্যন্ত খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রামে ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৩৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। ঘূর্ণিঝড়ে ১৯ জেলার ১০৭ উপজেলায় ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জেলাগুলো হলো– সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জেলায় নগদ সহায়তার ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ৫ হাজার ৫০০ টন চাল, ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশুখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, গোখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) প্রাথমিক হিসাবে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের ১০টি জেলার ৮৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৭ লাখের বেশি শিশু এবং প্রায় ৪৩ লাখ নারী রয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ঘূর্ণিঝড়ে দেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৭ শতাংশ ফসল ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে মাছের ঘেরেরও। তবে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনও হয়নি।

ঘূর্ণিঝড় রিমালে বিতরণ লাইন লন্ডভন্ড হওয়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দেশের দুই কোটি ৭০ লাখ গ্রাহক। টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি বলছে, বিদ্যুৎ না থাকায় ৬৪ জেলার ২২ হাজার মোবাইল সাইট (টাওয়ার) অচল হয়ে পড়েছে, যা মোট সাইটের ৪৮ শতাংশের বেশি।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির খুব বেশি দৃশ্যমান হিসাব পাওয়া যাবে না। যেমন সেতু ভেঙে পড়েছে, গাছ উপড়ে গেছে বা বাড়িঘর ধসে গেছে। কারণ, এ ঝড়ে মূল ক্ষতি করেছে দেশের বেশির ভাগ এলাকায় চলা টানা ভারী বৃষ্টি। এ বৃষ্টির কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি।