বাংলাদেশ তৈরির নেপথ্য কারিগর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব

সারাদিন ডেস্কসারাদিন ডেস্ক
প্রকাশিত: ৪:০০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৮, ২০২২

“কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।”
-কাজী নজরুল ইসলাম

বিদ্রোহী কবির এই কবিতার লাইনগুলোর প্রতিটি শব্দ যেন একজন মহীয়সী নারী, একজন রত্নগর্ভা মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্য উৎসর্গকৃত। এই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বঙ্গমাতা নিভৃতচারী ছিলেন। বৈরী সেই সময়ে আমাদের প্রজন্মের বঙ্গমাতা সম্পর্কে খুব বেশি জানার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ইতিহাসকে কখনও মাটি চাপা দিয়ে রাখা যায় না। সময়ের পরিক্রমায় তা একদিন নিজ মহিমায় ঠিকই আত্মপ্রকাশ করে।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিটি ধাপে এবং ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে স্বর্ণাক্ষরে লিখা রয়েছে একজন সাহসী যোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহধর্মিণী, আমৃত্যু সহচর, মহীয়সী নারী, রত্নগর্ভা মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নাম। বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রতিটি অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার সমান্তরালে নেপথ্যে থেকে ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে হিমালয় সমআসনে অধিষ্ঠিত করতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

বঙ্গমাতা ছিলেন অতি সাধারণ বেশভূষা, আভরণহীন, চাকচিক্য মুক্ত এক শাশ্বত বাঙালি মাতৃরূপ। শাশ্বত মাতৃরূপের আড়ালে তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন সাহসী একজন যোদ্ধা। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। এমনকি সরাসরি রাজনীতির সাথে তিনি সম্পৃক্ত না থাকলেও অন্তরালে থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছেন। বঙ্গবন্ধু যখন জেলখানায় থাকতেন তখন তাঁর অবর্তমানে সংগঠন পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

একদিকে যেমন নেতা-কর্মীদের দিক নির্দেশনা দিতেন, সাহস দিতেন, পরামর্শ দিতেন। অন্যদিকে, সংগঠন চালানোর প্রয়োজনীয় অর্থও তাঁকেই জোগাড় করতে হতো। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে থাকতেন তখন গোয়েন্দা সংস্থা ও সামরিক জান্তার চোখ এড়িয়ে বঙ্গমাতা অত্যন্ত সুকৌশলে জেলগেটে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গিয়ে নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর দিতেন আবার জেলগেট থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত দিক-নির্দেশনাও নেতা-কর্মীদের পৌঁছে দিতেন। তিনি সবসময় বঙ্গবন্ধুকে উজ্জীবিত করেছেন, ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা বঙ্গবন্ধুকে নির্ভিকচিত্তে দেশের কাজ করতে সাহায্য করেছে। ইচ্ছে করলেই তিনি তাঁর স্বামীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে এনে সংসারে মনোযোগী করতে পারতেন, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে সংসার করতে পারতেন। তা না করে তিনি সবসময় সংসার, ছেলে-মেয়ের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সংসারের পিছুটান থেকে দূরে রাখতেন। এতে করে বঙ্গবন্ধু’র পক্ষে শতভাগ দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করা সহজ হয়েছে।

দেশ বিভাগের পূর্বে ১৯৪৬ সালে দাঙ্গার সময় বঙ্গমাতা নিজের অসুস্থতা সত্ত্বেও স্বামীকে নিজের কাছে না রেখে কলকাতার দাঙ্গা পীড়িত মানুষকে সহায়তা করার জন্য পরামর্শ দিয়ে দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গমাতার বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর। সেই কৈশোর উত্তীর্ণ বয়স থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর যোগ্য হয়ে ওঠে ছিলেন।

Nagad

ঐতিহাসিক ৬-দফা ও ১১-দফার আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ অবদান রাখেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর সাহসী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তের জন্য মামলার সকল রাজবন্দীর জীবন রক্ষা হয় এবং এর ফলে স্বাধীনতার আন্দোলন আরও বেগবান হয়। এ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা এবং লাহোরে গোল টেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় বঙ্গমাতাকে ভয় দেখানো হয় পাকিস্তানিদের শর্ত না মানলে তিনি বিধবা হবেন। বঙ্গমাতা বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে বঙ্গবন্ধুকে মাথা নত না করার সাহস জোগান এবং প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বৈঠকে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত দেন। বঙ্গবন্ধু প্যারোলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানের চাপে পাকিস্তান সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় দেয়া বঙ্গবন্ধু’র ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি ভাষণ, যা ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃত। এই ঐতিহাসিক ভাষণেও বঙ্গবন্ধুকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে বঙ্গমাতা “তোমার যা মন চায়, তুমি তাই বলবে।”

২৬ শে মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর পরই পাকসেনারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেন, বঙ্গমাতা তখন পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পর থেকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বঙ্গমাতা তাঁর সন্তানদের নিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেই অবস্থায় থেকে তার দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানিরা, দুই সন্তান মুক্তিযুদ্ধে, বাকি তিন সন্তানকে নিয়ে তিনি গৃহবন্দি, সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, এছাড়াও বড়কন্যা শেখ হাসিনা তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন। অসীম সাহস ও ধৈর্য নিয়ে তিনি সেই সময়ের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। আন্দোলন সংগ্রামের উত্তাল সময়গুলোতে নিজ বাড়িতে পরম মমতায় নির্যাতিত নেতা-কর্মীর আত্মীয় স্বজনদের আপ্যায়ন করতেন, সুবিধা-অসুবিধা শুনে ব্যবস্থা নিতেন। আশাহত নেতাকর্মীরা তাঁর কথায় আশার আলো পেতেন। বেগম মুজিবের আশাজাগানিয়া বক্তব্য থেকে আসতো আন্দোলনের জ্বালানি।

সদ্য স্বাধীন দেশে সম্ভ্রম হারা নির্যাতিতা নারীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “বীরাঙ্গনা তুই কাঁদিস কেন? তুই আমার মা।” এছাড়াও তিনি বলেছিলেন “প্রত্যেক বীরাঙ্গনার বাবার নামের জায়গায় আমার নাম আর ঠিকানা আমার ঠিকানা লিখে দাও।” ঠিক একইভাবে বীরাঙ্গনাদের বুকে টেনে নেন। তাঁদের জন্য ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’ গড়ে তোলেন তিনি। তাঁদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও জীবিকার ব্যবস্থা করেন। বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গমাতা বলেন “আমি তোমাদের মা।” নিজের গায়ের গয়না খুলে দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন জীবনদান করেন তিনি। শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য নাম। “Truly they are made for each other…… “ অর্থাৎ তাঁদের জন্মই হয়েছিল একে-অপরের জন্য। বঙ্গমাতা বাঙালির ইতিহাসে একজন সর্বংসহা সহধর্মিণীর নাম, বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু হার না মানা দুঃসাহসী সহযোদ্ধা ও বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মীর নাম, জন্ম জন্মান্তরের বন্ধনের নাম। বাঙালির আবেগ, অনুভূতির নাম।বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের নীরব-নিভৃতচারী নেপথ্যের কারিগর তিনি।

লেখক: ডা. মো. মুরাদ হাসান, এমপি

সারাদিন.৮ আগস্ট. আরএ