বাংলাদেশ চাপে থাকলেও এখনও সংকটে পড়েনি: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

সারাদিন ডেস্কসারাদিন ডেস্ক
প্রকাশিত: ৭:৫৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩০, ২০২২

সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ চাপে থাকলেও এখনও সংকটে পড়েনি। কিন্তু, যদি চাপ অস্বীকারের মনোভাব থাকে এবং এ চাপ সময়মতো ঠিকভাবে মোকাবিলা করা না হয়, তাহলে তা কাঠামোগত সমস্যায় রূপান্তরিত হবে। এটা অবধারিত সত্য। একইসঙ্গে দেশের অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যতে বিশ্বাস রাখেন, এমন শক্তিকে সামনে আনতে হবে।

আজ মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) রাজধানীর পল্টনে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ইআরএফ ডায়ালগ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শারমিন রিনভী। ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘গত দেড় দশকে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও বৈষম্য বেড়েছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি, টাকার বিনিময় হার ও সুদের হার—অর্থনীতির এই তিন চলকের মধ্যে সমন্বয় নেই। চাপ মোকাবিলায় সরকার কিছু সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু, কোনো সমন্বিত উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না।’

জ্বালানির দাম বাড়ানো-কমানোর ঘটনা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘জ্বালানির দাম ৪০ শতাংশের বেশি বাড়িয়ে আবার পাঁচ টাকা কমানো হলো। দাম বাড়ানোর সময় সামগ্রিক হিসাব না করে শুধু একটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তগুলো কোথায় হচ্ছে, কে নিচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়—হয়তো এসব সিদ্ধান্ত আমলারাই নিচ্ছেন। কারণ, জনপ্রতিনিধিরা এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় যুক্ত আছেন বলে মনে হয় না।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এসব কারণেই এসব সিদ্ধান্ত বারবার পরিবর্তন করতে হয়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলো ও তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় নেই। এভাবে বাংলাদেশে যত সমস্যা আছে, তা আরও বেশি জটিল হয় সমন্বয়হীনতা ও দক্ষতার অভাবের কারণে।’

Nagad

দেশে বর্তমানে যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে, তা স্বীকার করে নিয়ে সামনে এগোতে পরামর্শ দিয়েছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘সরকারের মধ্য থেকে যাঁরা বলছেন, আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, তাঁরা কোনো উপকারী মন্তব্য করছেন না। বরং, এতে বাজারে আরও নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাঁরা যত অস্বীকারের মনোভাবে থাকবেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তত বিলম্বিত হবে।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এক দশক ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে। এর অর্থ আয় বাড়ছে। তাহলে কর সংগ্রহ হচ্ছে না কেন? তাহলে কি কর সংগ্রহ করা হচ্ছে না? নাকি হিসাবের গড়মিল আছে? কর সংগ্রহ করতে না পারার কারণে এখন আমদানি করা যাচ্ছে না। খাদ্য সহায়তা বাড়ানো যাচ্ছে না। শুল্ক কমাতে পারছে না। পরোক্ষ কর থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করতে হচ্ছে বেশি। যা সাধারণ মানুষকে চাপে ফেলছে।

তিনি আরও বলেন, সরকার ভৌত অবকাঠামোতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সেই বরাদ্দ থাকছে না। ২০টি মেগা প্রকল্পের জন্য জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকছে জিডিপির এক শতাংশ। শিক্ষাতেও সমপরিমাণ।

‘রাজনৈতিক শক্তি বৈধতার জন্য খুব দ্রুততার সঙ্গে দৃশ্যমান ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করতে চাচ্ছে। রাজনৈতিক ঘাটতি পূরণের চেষ্টা হচ্ছে। কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগের ফল আসতে দশকের বেশি সময় লাগে। রাজনৈতিক চক্রে এ সময় নেই। পাশাপাশি সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের কারণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বৈষম্য হচ্ছে। করোনার সময় সহায়তা বিতরণে বড় ধরনের বৈষম্য দেখা দিয়েছে, যার যা প্রাপ্য তা নথিভুক্ত হয়নি। ফলে প্রমাণিত হয়েছে সরকারের সেবা পাওয়ায় দুর্বল নাগরিকদের জন্য সহজ নয়’ বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

তিনি বলেন, দেশে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। বিশেষ জায়গা থেকে বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে মেধাভিত্তিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যক্তি বিনিয়োগ বিকশিত হচ্ছে না। এর ফলে ক্ষতি হচ্ছে সরকার, মানুষ ও দেশের। বিদ্যুৎ, জ্বালানিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে। বিচারের সুযোগও তুলে নেওয়া হয়েছে।

সিপিডির ফেলো আরও বলেন, পুঁজিবাদের বিকাশে সব দেশেই লুণ্ঠন হয়। বাংলাদেশে প্রথমে আর্থিক খাতে লুণ্ঠন হয়েছে। পরে হয়েছে পুঁজিবাজারে। এখন সরকারি প্রণোদনায় অতিমূল্যায়িত প্রল্পের মাধ্যমে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান লুণ্ঠন করছে। তবে লুন্ঠনের পরে বিচার ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে তা দেখা যাচ্ছে না। এখানে প্রতিযোগিতার চেয়ে সংযোগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে জবাবদিহিতার জায়গা দুর্বল হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে প্রধান রাজনৈতিক শক্তির।’