শেয়ারবাজার কারসাজিতে সাকিব আল হাসানের কোম্পানির নাম

নিজস্ব প্রতিবেদক:নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রকাশিত: ৩:১৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২

সব সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থাকেন শেয়ার বাজারে বিভিন্ন সময়ে কারসাজির পেছনে জড়িতরা। কিন্তু এবার অনেকের নাম প্রকাশ্যে এসেছে। সম্প্রতি শেয়ারের ব্যাপক কারসাজির প্রমাণ পেয়েছে দেশের প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। সংস্থাটির এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে কীভাবে কারসাজি হয়েছে, কারসাজির সঙ্গে জড়িত চক্রের তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে নাম এসেছে মোনার্ক হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাদিয়া হাসানের; যে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান।

জানা যায়, সাতটি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল টাকা তুলে নিয়েছে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সাকিবের কোম্পানি মোনার্ক হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ আনা হয়েছে এবং জরিমানা করা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের শীর্ষ ক্রেতাদের মধ্যে সাকিব আল হাসানের নামও আছে। তবে তিনি এই শেয়ার কিনেছেন অন্য একটি ব্রেকারেজ হাউস থেকে।

যে সাত কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হয়েছে সেগুলো হলো ওয়ান ব্যাংক, বিডিকম অনলাইন, ফরচুন সুজ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, এশিয়া ইনস্যুরেন্স, গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স ও ঢাকা ইনস্যুরেন্স।

এসব কোম্পানির শেয়ার দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে বিপুল মুনাফা তুলেছেন হিরো ও তাঁর সহযোগীরা। আর হিরোর ভেলকিতে পড়ে এসব শেয়ার কিনে টাকা হারিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

Nagad

বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, হিরো ও তাঁর সহযোগীরা ২০২১ সালের জুন থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ধারাবাহিক লেনদেনের মাধ্যমে সাত কোম্পানির শেয়ার কারসাজি করেন। পুঁজিবাজারে বিএসইসির নির্দেশে ডিএসই গত বছরের ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বিডিকম অনলাইন ও ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ার কারসাজির অভিযোগ তদন্ত করে।

তদন্তে শেয়ার কারসাজির প্রমাণ পায় ডিএসই। এ ধরনের সিরিজ লেনদেন সিকিউরিটিজ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ কারণে আবুল খায়ের হিরো ও তাঁর স্ত্রী মোনার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিয়া, বাবা এবং তাঁর সহযোগী ডিআইটি কো-অপারেটিভ লিমিটেডকে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। জরিমানার টাকা আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে বিএসইসির ইস্যু করা ব্যাংক ড্রাফট-পে অর্ডারের মাধ্যমে জমা না করলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়।

জানা গেছে, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, জেনেক্স ইনফোসিস, ফরচুন শুজ ও সোনালী পেপারের নামে শেয়ার কেনাবেচার কাজটি তদারকি করেছিলেন হিরো।

ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে ২০ টাকা ১০ পয়সা হয়েছে, শতাংশের হিসাবে বেড়েছে ৫৯ দশমিক ৬২ শতাংশ।

তদন্তে ডিএসই দেখা যায়, আবুল খায়ের হিরোর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান (ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের ক্লায়েন্ট কোড # ৩৮৯৮) এ সময়ের মধ্যে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের শীর্ষ ক্রেতা ছিলেন। তিনি হিরোর স্ত্রী এবং মোনার্ক হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এ ছাড়াও মো. আবুল খায়ের হিরো সেই সময় (অগ্রণী ইক্যুয়িটি অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ক্লায়েন্ট কোড # এবিএম ৬৪৫) থেকে ব্যাংকটির দ্বিতীয় শীর্ষ ক্রেতা ছিলেন। এ ছাড়াও হিরোর বাবা আবুল কালাম মাতবর (ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজের ক্লায়েন্ট কোড ৯১৬৬) এবং হিরোর বোন কনিকা আফরোজ ওয়ান ব্যাংকের প্রধান ক্রেতা ছিলেন।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত বছরের ১৫ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির শীর্ষে ছিলেন কাজী সাদিয়া হাসান। তিনি ৩ কোটি ৯৮ লাখ ২৯ হাজার ৯৩৬টি শেয়ার কিনেছেন এবং তদন্তের সময় ব্যাংকটির ২ কোটি ৩৩ লাখ ৫৬ হাজার ১১০টি শেয়ার বিক্রি করেছেন। যা এই সময়ের মধ্যে ব্যাংকটির মোট লেনদেনের ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদন ও বিএসইসির জরিমানার আদেশ থেকে জানা যায়, গত বছরের ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বরের ওই ১৫ দিনে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দাম সাড়ে ৭ টাকা বা ৬০ শতাংশ বেড়ে যায়। তাতে হিরো, তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বাবা আবুল কালাম মাতবর, বোন কনিকা আফরোজ এবং তার সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান ক্যান্ডেলস্টোন ইনভেস্টমেন্টস পার্টনার্সসহ একাধিক অনুসারী ও সহযোগীর ১৪টি বিও হিসাবে প্রায় ১৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা মুনাফা হয়। একই সময়ে ১৪টি বিও হিসাবে অনাদায়ী (আনরিয়ালাইজড) মুনাফার পরিমাণ ছিল ১৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

এ ছাড়া চলতি বছরের ৭ থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত সময়ে বিডিকম অনলাইনের শেয়ারের দাম ২৩ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে ৩৪ টাকা ৩০ পয়সা হয়েছে। শতাংশের হিসাবে ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে কোম্পানিটির শেয়ার দর। ডিআইটি কো-অপারেটিভ, যেটি এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ক্লায়েন্ট কোড এস ২১১৬ এবং বিও আইডি ১৬০৪৫৩০০৬৫৭৫৭৮১-সহ আলোচ্য সময়ের মধ্যে বিডিকম অনলাইনের পাঁচ জন শীর্ষ ক্রেতা ছিলেন।

এই দুটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯-এর ধারা ১৭ অনুসারে, জরিমানা করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

এ প্রসঙ্গে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বাজারের শৃঙ্খলা ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে কারসাজির তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে আইন মেনে তা নিষ্পত্তি করা হয়। এ ধরনের ব্যবস্থা ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে।

শেয়ারবাজারে কারসাজি প্রসঙ্গে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী গতকাল বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে, বিএসইসি নিশ্চয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। একের পর এক কারসাজি হতে থাকলে পুঁজিবাজার ভালোর দিকে যাবে না।