জলতরঙ্গ হাউজবোট, জল ও জীবন যেখানে একে অপরের সুহৃদ

বাংলার পথিক:বাংলার পথিক:
প্রকাশিত: ৯:০৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৮, ২০২২

ভাবুনতো একবার? পরিষ্কার আকাশে অসংখ্য তারার মেলা, দূরে মেঘালয়ের আঁকাবাঁকা পাহাড়, আর আপনি ভেসে আছেন তারই পদতলে স্বচ্ছ জলের উপরে প্রিয়জনদের সাথে নিয়ে। সুনামগঞ্জের নাম অনেক কারণে বিখ্যাত হলেও টাং গুয়ার হাওর তাকে এনে দিয়েছে বিশ্ব পরিচিতি। যুগের চাহিদার সাথে ভ্রমণ পিপাসুদের একটু আরামদায়ক ও নিরাপদ আনন্দ প্রদানের লক্ষে এই শহরে গড়ে উঠেছে আধুনিক হাউজবোট ট্যুরিজম।

শুধু স্থানীয় মানুষজন নয়, অনেক তরুণ উদ্যোক্তা, ট্রাভেল গ্রুপ তাদের টিম মেম্বারদের প্রিমিয়াম সার্ভিস প্রদানে টাং গুয়ার হাওরে হাউজবোট চালু করেছে । যার মাধ্যমে হাওর অঞ্চলের আপামর অর্থনীতিতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। আমাদের দেশে একটি ধারনা আছে যে হাওরের মৌসুম কেবল বর্ষাকাল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হাওড়

শীত কিংবা বর্ষা কখনো শুকায় না। বরং বর্ষার ফুলে ফেঁপে ওঠা হাওরের চেয়ে শীতের ক্রিস্টাল জলরাশি আর অতিথি পাখির বিচরণে মুখরিত হাওর আরও বেশি দৃষ্টিনন্দন ও সুন্দর। একমাত্র বসন্ত ছাড়া সব সিজনেই হাওর সুন্দর।

ঢাকা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসি, নন এসি বাস যেমন শ্যামলী, হানিফ, মামুন পরিবহন সহ অনেক ভালো বাস সার্ভিস সুনামগঞ্জ আসে। এরপর সকালে সেখান থেকে হাউজবোটে উঠে কখনো নদী কখনো হাওরের বুকে ভেসে থাকার এই আয়োজনটা হয় প্রায় দুই দিন এক রাতের।

Nagad

এবার আসি সুনামগঞ্জের একটি বিশেষ হাউজবোট “জলতরঙ্গ” নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী গল্প শোনাতে। ইফতেখার হামিদ একজন তরুণ উদ্যমী ট্রাভেলার, অনলাইন ভিত্তিক ট্রাভেল গ্রুপগুলোতে খুব জনপ্রিয় মুখ। গতবছর সে তার বন্ধু সাগর আর ব্যবসায়ীক পার্টনার আরাফাত মিলে টাং গুয়ার হাওরে একটি হাউজবোট নামালেন নাম দিলেন “জলতরঙ্গ”।

২০ ফিট চওড়া আর ৮১ ফিট লম্বা কম শব্দের এই হাউজবোট সবার প্রশংসা কুড়ালো। ইফতেখার আশায় বুক বাধলেন এই বছর বর্ষায় লাভের মুখ দেখবেন। জলতরঙ্গ সুনামগঞ্জের শহর থেকে ছেড়ে ওয়াচ টাওয়ার, টেকেরহাট আর যাদুকাটা হয়ে প্রায় ২ দিন ১ রাত পর পুনরায় শহরে ফিরে আসতো। যে কারণে পর্যটকদের আসা যাওয়া এবং হাওর ঘোরা সহজ হতো। দিন যতো যাচ্ছিলো প্রায় প্রতিদিন জলতরঙ্গ হাউজবোট হাউজফুল পর্যটক নিয়ে ঘুরতে থাকলো হাওরের বুকে।

২০২২ সালের ১৫ই জুন, ইফতেখার নিজেই ১২ জন ডাক্তারের বিশেষ একটি দলকে হাওর দেখাতে জলতরঙ্গ হাউজবোটে নিয়ে গেলো। সেরাতে তারা হঠাৎ বৃষ্টি পেলো। হাওরের বৃষ্টি অনেক উপভোগ্য। কিন্তু সেই বৃষ্টিটা ছিলো অনেক ভয়ংকর। যাদুকাটা ঘুরে জলতরঙ্গ যখন সুনামগঞ্জ ফিরছে তখনও বৃষ্টি চলছে। সেরাতে আবহাওয়া একটু বেশিই খারাপ হতে থাকলো। সুনামগঞ্জ এসে ইফতেখার এই আবহাওয়ায় আর নৌকা থেকে নামা সমীচীন মনে করলেন না।

১৬ তারিখ গেস্টদের নিয়ে সুনামগঞ্জ শহরে এসে দেখলেন বন্যা। তিনি গেস্টদের নামিয়ে বাকি সবাইকে নিয়ে হাউজবোটে রইলেন। মাঝরাতে হঠাৎ শহরের বিদ্যুৎ চলে গেলো। চারিদিকে নেমে এলো অন্ধকার।পরের দিন ভোরের আলো ফুটলোনা। বৃষ্টি অঝোরে পড়ছেই। ইফেতেখার সকালে সবার খাবারের চিন্তায় নৌকার নোঙর খুলতে গিয়ে দেখে ঘাট পানির তলে। শহরের যে মানুষ রাতে রাস্তায়-দাঁড়িয়ে ছিলো তাদের কোমর সমান পানি। মাত্র ১২ ঘণ্টার ফ্ল্যাশ ফ্লাডে ডুবে গেছে সুনামগঞ্জ শহর। এবং পানির উচ্চতা ক্রমশ বাড়ছেই। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ইফতেখারকে দেখে কিছু নারী ও শিশুদের তাদের হাউজবোটে তুলে নিতে বললেন। তিনি সাত-পাঁচ না ভেবে গেস্টদের ভিতরের রুমে পাঠিয়ে সবার জন্য হাউজবোট উন্মুক্ত করে দিলেন। আবারো শুরু হলো বৃষ্টি, দেখতে দেখতে মুহূর্তে সুনামগঞ্জ ৫ ফিট পানির নিচে। পুরা শহরে নৌকা আর হাউজবোট ছাড়া সবই পানির নিচে।

১৭ জুন জলতরঙ্গ ফেসবুক পেজে একটি স্টেটমেন্ট এসেছিলো “মেঘালয়ের টানা বৃষ্টিতে নদ নদীর পানি বেড়ে সুনামগঞ্জ শহরে পানি উঠে গিয়েছে। স্থানীয় মানুষদের জন্য সবাই যে যেভাবে পারেন সহযোগিতা করার আহবান করা হচ্ছে। আমাদের দুই বোট- জলতরঙ্গ – Joltarongo ও Jolnibash-জলনিবাস এ আমরা এলাকার লোকজনদের তুলে নিয়ে আশ্রয় দেয়া হয়েছে, সবার বাড়ি ঘর ডুবে গেছে, খাবার পানি এবং খাবারের তীব্র সংকট। খাবারের প্রচুর সংকটেও কিছু শুকনো খাবার এরেঞ্জ করা হয়েছে আমাদের ২ বোটে আশ্রয় নেওয়া ৮০+ মহিলা, শিশু মুরুব্বিদের জন্য। বন্যার পানি নামতে আরও ৭২ ঘণ্টা প্লাস সময় লাগবে। বর্তমানে নৌকায় আমাদের সিন্ডিকেট মেম্বার Mohammad Arafat Hossain Akanda ভাই, Iftakhar Hamid ভাই ও ঘুরতে আসা ১২ জনের ডাক্তার টিম আছেন। আপনারা যারা সহযোগিতা করতে চান যোগাযোগ করে সহযোগিতা করতে পারেন। আমরা আমাদের সাধ্য মতো খাবার এবং শেল্টারে ব্যবস্থা করছি, আপনাদের সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। অসহায় মানুষদের জন্য সম্ভব্য সব করে যাচ্ছি আমরা।”

ইফতেখার তার হাউজবোটে রাখা ৪০০ লি: পানি

আর চাল ডাল যা ছিলো তাই দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে প্রায় ৮০-১০০ জন মানুষকে দুপুরের খাবার দিলেন। এবং পুরা হাউজবোট বন্যার্তদের সাহায্যে উৎসর্গ করলেন। সন্ধ্যায় আবহাওয়া আরও খারাপ হলো। আস্তে আস্তে নেটওয়ার্ক এর বাইরে চলে গেলো সবকিছু। তারই মাঝে হাউজবোটে যা ছিলো তাই দিয়ে চললো খাওয়া দাওয়া। রাতের ভয়াবহতা শেষ হতেই দিনে আরও মানুষ বাড়লো। তাদের এই হাউজবোট হয়ে গেলো রেসকিউ বোট। ইফতেখার একে একে তার ব্যবসায়ীক পার্টনার, বন্ধু ও ট্রাভেল গ্রুপ স্বপ্ন-ঘুড়িকে সাথে নিয়ে আরও কিছু সমমনা মানুষদের নিয়ে পুরো দমে নেমে গেলেন বন্যার্তদের পাশে। সবেমাত্র শুরু করা একটি প্রিমিয়াম হাউজবোট হাওরের অগণিত বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ালো। শুধু খাবারই নয় বিশুদ্ধ পানি, বিনামূল্যে ওষুধ এমনকি বন্যার্তদের ঘর তৈরিতে সহায়তা করে ইতিহাস করেছে দেশের প্রথম সারির হাউজবোট টি।

এভাবে কেটে গেলো ২৪ দিন। হাওরের পানি নেমে গিয়ে মানুষের জীবন স্বাভাবিক হতে লাগলো। কিন্তু বিরূপ প্রভাব পড়লো হাওর ভ্রমণে।

লোকজনের মনে বন্যা নিয়ে নানারকম আশংকা তৈরি হলো। এরই মাঝে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা “জলতরঙ্গ” হাউজবোট পুনরায় সার্ভিস দিতে প্রস্তুত করা হলো। কিন্তু তেমন সাড়া পড়লো না। আশানুরূপ পর্যটক পেতে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হলো ঈদ উল আযহা পর্যন্ত। ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। জলতরঙ্গ ফিরে পেলো তার পূর্বের অবস্থান, প্রায় প্রতিদিন নিত্য নতুন ভিন্ন বয়সী পর্যটক নিয়ে হাওরের বুকে ভেসে বেড়াতে শুরু করলো সে। এবছর জলতরঙ্গ প্রায় ৫০ টির কাছাকাছি হাওরের ট্রিপ পরিচালনা করেছে। একজন তরুণ ইফতেখার হামিদ,সাগর, কিংবা আরাফাত সেদিন ব্যবসায়ীক স্বার্থকে বড় করে দেখেনি। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও দৈনিক যুগান্তর জলতরঙ্গ ও জলনিবাস দুটি হাউজবোটকে প্রথম রেসকিউ জলযান হিসেবে উল্লেখ করে।

তরুণদের এই দেশপ্রেম একদিন হাওরের এই পর্যটনকে বহুদূরে এগিয়ে নেবে। যদি আগামীতে সুনামগঞ্জের হাওরে একটি রাত কাটাতে চান তবে কোনরকম চিন্তা না করে সবার

আগে ভিজিট করুন www.facebook.com/premiumhouseboat এই লিংকটিতে। এছাড়া ভ্রমণ গ্রুপ স্বপ্ন ঘুরি(www.facebook.com/swopnoghuri18) হাওরে জলতরঙ্গ হাউজবোটে নিয়মিত ইভেন্ট করছে।

সকলের ভালোবাসা ও শুভকামনায় সুনামগঞ্জের হাওরে জলতরঙ্গ তার আবিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে সেই প্রত্যাশা সবার।

সারাদিন. ৮ ডিসেম্বর