পতিত জমিতে মিশ্র ফলের আবাদ, সফল কৃষি উদ্যোক্তা কবির

আনসারী (ঝিনাদাহ প্রতিনিধি):আনসারী (ঝিনাদাহ প্রতিনিধি):
প্রকাশিত: ৬:০৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৮, ২০২৩

পুকুর পাড়ের পতিত জমিতে মিশ্র ফল চাষ করে সফল হয়েছেন ঝিনাইদহে কৃষি উদ্যোক্তা কবির হোসেন। মাছ চাষের পাশাপাশি করছেন চায়না, দার্জিলিং কমলা, মাল্টা, পেয়ারা, ড্রাগন ও পেঁপের চাষ। ফলন ভালো হওয়ায় জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলাগুলোতেও বাজারজাত করা হচ্ছে। পতিত জমিতে এমন মিশ্র ফল চাষে কৃষি-বিভাগের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে না পরামর্শ। সেই সাথে পুকুর পাড়ের পতিত জমিতে মিশ্র ফলের চাষ এবং বিলের বিশাল এরিয়া জুড়ে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মহেশপুর উপজেলার করিঞ্চা গ্রামের উকড়ির বিলের পাশে মাছ চাষের পাশাপাশি পুকুর পাড়ের পতিত জমিতে করছেন মিশ্র ফল চাষ। বাগানে গেলে দেখা মেলে সারি সারি গাছের সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছে সবুজ ও হলুদ রংয়ের কমলা ও মাল্টা। কাঁচা অবস্থায় গাড় সবুজ ও পেকে ধারণ করেছে গাড় হলুদ রং। শীতের শুরুতে গাছ ভর্তি এমন ফল বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধির সাথে সাথে তার স্বপ্ন জেনো দোল খাচ্ছে। পুকুর পাড়ে মিশ্র ফলের আবাদ করে নিজে অর্থনৈতিকভাবে স্বাভলম্বি হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন ৩০ থেকে ৩৫ জন মানুষের। তার এমন ব্যতিক্রমী চাষে আগ্রহী হয়ে অনেক কৃষকই ঝুঁকছে এমন চাষে। এই ব্যতিক্রমী মিশ্র চাষ করছেন মহেশপুর উপজেলার তৈলটুপি গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা কবির হোসেন।

কবির হোসেনের ১’শত বিঘা জমিতে ১৬টি পুকুরে রয়েছে যেখানে চাষ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তার পুকুর পাড়ে রয়েছে সাড়ে ৭ শত মাল্টা , ২ হাজার ৫’শ ড্রাগন, ৫’পেঁপে, ৩’শ চায়না কমলা ও ১’শ দার্জিলিং কমলা। প্রতিমাসে তার আয় কয়েক লক্ষ টাকা।

গ্রামে কৃষক আবুল কালাম বিশ্বাস জানান, তিনি প্রতিদিন পুকুর পাড়ে ঘাস কাটতে আসেন। এর আগে কখনো পুকুর পড়ে এতো ফল দেখেননি। তিন বছর ধরে এই ফল গাছ দেখছেন। যেখানে কমলা, মাল্টা, পেঁপে, ড্রাগন, পেয়ারা এই ফলগুলো পুকুর পাড়ে চাষ হচ্ছে।

পুকুর পাহারাদার রেজাউল ইসলাম জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই পুকুর এবং বিল পাহারা কাজ করছেন। এর আগেও এখানে অনেক লোক আসছে মাছ চাষ করতে, তখন পাড়ে কিছুই হতোনা বা কেউ এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কিন্তু কবির হোসেন ইজারা নেওয়ার পর থেকেই তিনি পুকুর পাড়ে মিশ্র ফলের চাষ করেছেন। এখন পুকুর পাড়গুলো দেখতেও অনেক ভালো লাগে আবার অনেক লোক ঘুরতেও আসছে। আশা করি কবির হোসেন অনেক লাভবান হবেন।

Nagad

পুকুর প্রজেক্টের ম্যানেজার মুক্তার আলী জানান, এর আগে তিনটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছিলেন। কিন্তু কোথাও দেখেননাই মাছচাষের পাশাপাশি মাল্টা, চায়না কমলা, ড্রাগনসহ বিভিন্ন ফলের চাষ করতে। এই প্রথম তিনি পুকুর পাড়ে ফলের চাষ করতে দেখছেন। এখন এই পুকুর পাড়ে ও বিলে ঘুরতে এবং ফলের বাগান দেখতে প্রতিদিন শতশত মানুষ আসছে বলেও জানান তিনি।

উদ্যোক্তা কবির হোসেন বলেন, কৃষিকে আরও সমৃদ্ধ করতেই এমন উদ্যোগ। আগামীতে কৃষি থেকেই সর্বোচ্চ অর্থ আয় হবে বলে তার প্রত্যাশা। এই প্রজেক্টটা ব্যক্তিগত উপার্জন। ৬ বছরে জন্য সরকারের থেকে লিজ নিয়ে মাছচাষ শুরু করি। এখানে অনেকটাই অগোছালো ছিল, অনেক টাকা ব্যয় করে ১৩/১৪ ফুট পাড় সৃষ্টি করে সুন্দর করে কেটে মাছ চাষ এবং ফল চাষের উপযোগী করি। এখানে মাটির বোন্ডিং বেশি ভালো নয় যার কারণে অনেক জায়গাই ভেঙে গেছে। তার ভিতর দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি পাড় গুলো টিকিয়ে রাখার জন্য। একই সাথে চিন্তা করি মাছ চাষ করার পাশাপাশি পাড়ে এতো জায়গা পড়ে আছে, এই জায়গাই এমন কিছু করে দেখাব যা দেখে আরও অনেকেই উদ্বুদ্ধ হবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে চায়না কমলা, মাল্টা বরি-১, দার্জেলিং কমলা লাগিয়েছি।

বর্তমানে চায়না কমলার বাম্বার ফলন হয়েছে। এখন অনেকেই দেখতে আসছে। অনেকেই আমার দেখাদেখি এই চাষ করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক মানুষ আসার কারণে জায়গাটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আমার ইচ্ছাও এখানে মাছ, ফলের বাগান এবং পাশের উকড়ির বিল সমন্বয় করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার।

আরও বলেন, আমি নিজের স্বার্থ না ভেবে সরকারি জমি এবং মালিকানা জমি লিজ নিয়ে ফলের গাছ লাগিয়েছি এবং মাছ চাষ করছি। আমরা যদি প্রত্যেকে সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে থাকি তাহলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। চিন্তা করেছি আগে শুরু করি এবং আমি যদি এখানে চাষ করতে না পারি তাহলে আমার পরিবর্তে যে আসবে সে এইগুলো দেখাশুনা করবে বা তার হয়ে যাবে। আজ এখানে এই ফলের বাগান করেছি যার কারণে এখানে শতশত মানুষ আসছে এই বাগান দেখার জন্য এবং এমন বাগান করবার জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ, আমরা যদি চেষ্টা করি তাহলে অন্যান্য খাতের মত কৃষি খ্যাত থেকেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বর্তমানে আগের মত আর কৃষি নাই, কৃষিটাকে যদি আমরা যদি বাণিজ্যিক ভাবে চিন্তা করি তাহলেই সম্ভব। আমরা কৃষিপণ্য রপ্তানি করেই, কোন বৈদেশিক ঋণ ছাড়াই কৃষির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারি। তবে কৃষির উপর সরকারকে ব্যাপক ভাবে নজর দিতে হবে।

আরও বলেন, আমরা যখন বেশি পরিমাণ ফল উৎপাদন করি, সেগুলোকে বিক্রয় করা বা বাজার জাত করা বড় একটা সমস্যা হয়ে দাড়াই। সেই ক্ষেত্রে সরকার যদি বাজার জাত করার জন্য একটু মনোযোগী হয়, ফলটা যাতে পচে না যায় এবং কৃষক যেন তার সঠিক মূল্যটা পাই সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে অনেকে কৃষি কাজে আগ্রহী হবে। সর্বশেষ উন্নত বাংলাদেশ দেখতে হলে কৃষির উপর সহযোগিতার মনোভাব এবং বিভিন্ন ধরণের সাহায্য সহযোগিতাও বাড়াতে হবে।

ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ আজগর আলী বলেন, পতিত জমি চাষ করতে উদ্বুদ্ধের পাশাপাশি সকল ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ। কবির হোসেনের পুকুর পাড়ের মাটি এটেল মাটি এবং কমলা চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় সে কমলাটা চাষ করতে পরেছে। কমলার শেকড় অনেক গভীরে যায়, যার কারণে একবার পানি দিলে অনেক দিন পানি না দিলেও কোন সমস্যা হয় না। আর এটেল মাটিতে সবমসময় সেচ দেওয়া লাগেনা। পুকুর পাড়ে কমলা চাষ করায় গাছের শিকড়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পাই যেকারণে ভালো মানের ফল উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। তার উৎপাদন খরচ বলতে তেমন কোন খরচ নেই। শুধু প্রথমে চারা রোপণ করার জন্য যে টাকা-টা খরচ হয়েছে এবং জৈব সার ব্যবহার করেই তিনি এই ফলন পাচ্ছেন। তবে তিনি মাছ চাষের পাশাপাশি একবার বিনিয়োগ করেই ভালো একটা ফলন পাচ্ছেন। এই ধরনের চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে বলেন আশা করছি।

সারাদিন. ৮ জানুয়ারি