‘ব্রয়লার মুরগির মাংস নিরাপদ, জনস্বাস্থ্যের জন্য কোনো ঝুঁকি নেই’
ব্রয়লার মুরগির মাংস একটি নিরাপদ খাদ্য এবং ব্রয়লার মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যের জন্য কোনো ঝুঁকি নেই। ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়া নিরাপদ কিনা, এ বিষয়ক গবেষণায় এসব ফলাফল পাওয়া যায়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ও উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অধীনে গবেষণাটি গত জানুয়ারি-জুন ২০২২ খ্রিঃ সময়ে পরিচালিত হয়েছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে দেখা যায় যে, ব্রয়লার মুরগির মাংসে, হাড়ে এবং কম্পোজিটে মূলত দুইটি এন্টিবায়োটিক (অক্সিটেট্রাসিাইক্লিন ও ডক্সিসাইক্লিন) এবং ৩টি হেভি মেটালের (আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড) সামান্য উপস্থিতি রয়েছে, যা অস্বাভাবিক নয় এবং তা সর্বোচ্চ সহনশীল সীমার অনেক নিচে। খামার এবং বাজারে প্রাপ্ত ব্রয়লার মাংসের চেয়ে সুপারশপের ব্রয়লার মাংসে এন্টিবায়োটিক এবং হেভি মেটাল এর পরিমাণ কম রয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক আজ বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) সকালে সচিবালয়ে তথ্য অধিদফতরের সম্মেলন কক্ষে গবেষণার ফলাফল নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলেন।
এসময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শম রেজাউল করিম, কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব ড. নাহিদ রশীদ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ মো. বখতিয়ার, প্রধান তথ্য অফিসার মো: শাহেনুর মিয়া এবং গবেষণা টিমের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিফিংয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়া নিরাপদ কিনা, এ নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই ভ্রান্ত ধারণা বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক প্রচারণায় দেখা যায় যে, ব্রয়লার মাংসে এন্টিবায়োটিক, হেভি মেটাল এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ ধরণের বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের ফলে সাধারণ জনগণের মাঝে অনেক সময় ব্রয়লার মাংস সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্রয়লার মাংস খাওয়া কমিয়ে দেয়, ফলে ব্রয়লার শিল্পের উপর একটি বড় ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এই পরিস্থিতিতে, ব্রয়লার মুরগির মাংসে, হাড়ে, কম্পোজিটে (কলিজা, কিডনী এবং গিজার্ডের সমন্বয়) এবং মুরগির খাদ্যে কি পরিমাণ এন্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতু আছে তা নির্ণয় করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ও উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অধীনে গবেষণাটি করা হয়।
গবেষণায়, বাংলাদেশের পাঁচটি জেলা শহরের (ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং বরিশাল) ব্রয়লার খামার (ছোট, মাঝারি এবং বড়) এবং বাজার হতে ব্রয়লারের মাংস, হাড় ও কম্পোজিট এবং ব্রয়লার খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি ঢাকা জেলার তিনটি সুপার শপ হতে ব্রয়লার মুরগির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত প্রায় ১২০০টি ব্রয়লার মুরগি এবং ৩০টি ব্রয়লার মুরগির খাদ্য হতে ৩১৫টি নমুনা প্রস্তুত করে বহুল ব্যবহৃত ১০টি এন্টিবায়োটিক এবং ৩টি ভারী ধাতুর অবশিষ্টাংশের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়।
দশটি এন্টিবায়োটিকের মধ্যে ৭টি এন্টিবায়োটিক (এনরোফ্লক্সাসিন, সিপরোফ্লক্সাসিন, নিওমাইসিন, টাইলোসিন, কলিস্টিন, এমোক্সাসিলিন এবং সালফাডায়াজিন) পরীক্ষণের জন্য নমুনাসমূহ SGS Bangladesh Ltd. এর মাধ্যমে SGS Laboratory, Chennai, India-তে প্রেরণ করা হয়। বাকী ৩টি এন্টিবায়োটিক (ক্লোরামফেনিকল, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন এবং ডক্সিসাইক্লিন) এবং ৩টি ভারী ধাতু (আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড) পরীক্ষণের জন্য নমুনাসমূহ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীন আধুনিক উন্নত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ISO certified and accredited কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি, সাভারে প্রেরণ করা হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বিস্তারিত তুলে ধরেন কৃষিমন্ত্রী। তিনি জানান, ব্রয়লার মাংসে গড়ে ৮.০ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ৯.১ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ৬.২ পিপিবি আর্সেনিক, ১৯০.৭ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ২৫৯.১ পিপিবি লেড রয়েছে, যা সর্বোচ্চ সহনশীল/অবশিষ্ট সীমার চেয়ে যথাক্রমে ১২.৫ গুণ, ১০.৯ গুণ, ৬.৫ গুণ, ৫.২ গুণ এবং ২৩.১ গুণ নীচে রয়েছে।
ব্রয়লার মুরগির হাড়ের নমুনা পরীক্ষণের ফলাফলে দেখা যায়, গড়ে ৫৩.৭ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ২৭.০ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ৭.২ পিপিবি আর্সেনিক, ৪৩৯.৯ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ৪৬৪.৬ পিপিবি লেড রয়েছে, যা সর্বোচ্চ অবশিষ্ট সীমার চেয়ে যথাক্রমে ১.৮ গুণ, ৩.৭ গুণ, ৫.৫ গুণ, ২.২৭ গুণ এবং ১২.৯ গুণ নীচে রয়েছে।
ব্রয়লার মুরগির কম্পোজিটে (কলিজা, কিডনী এবং গিজার্ডের সমন্বয়) গড়ে ১৪.৫ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ১৭.২ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ১০.৯ পিপিবি আর্সেনিক, ২৩৯.২ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ৩০৭.৬ পিপিবি লেড রয়েছে, যা সর্বোচ্চ অবশিষ্ট সীমার চেয়ে যথাক্রমে ৬.৮ গুণ, ৫.৮ গুণ, ৩.৬ গুণ, ৪.১৮ গুণ এবং ১৯.৫ গুণ নীচে রয়েছে।
বাজার এবং খামার হতে সংগৃহীত ব্রয়লার মুরগির খাদ্যে গড়ে ০.৮ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ১৯.২ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ৪.১৯ পিপিবি টাইলোসিন, ৭.৬ পিপিবি আর্সেনিক, ২১৫৩.৩ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ৪৭৮.৬ পিপিবি লেড রয়েছে, যা আর্সেনিক এর ক্ষেত্রে ১৮৪.২ গুণ, ক্রোমিয়াম এর ক্ষেত্রে ৯.২ গুণ এবং লেড এর ক্ষেত্রে ২০.৮ গুণ সর্বোচ্চ অবশিষ্ট সীমার চেয়ে নীচে রয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, উৎস নির্বিশেষে ব্রয়লারের মাংসে দুইটি এন্টিবায়োটিক (অক্সিটেট্রাসিাইক্লিন ও ডক্সিসাইক্লিন) এবং ৩টি হেভি মেটালের (আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড) সামান্য উপস্থিতি রয়েছে, যা অস্বাভাবিক নয় এবং তা সর্বোচ্চ সহনশীল সীমার অনেক নিচে। ফলে ব্রয়লার মুরগির মাংস একটি নিরাপদ খাদ্য এবং ব্রয়লার মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যের জন্য কোনো ঝুঁকি নেই।
তিনি বলেন, মুরগির খাবারে ট্যানারির বর্জ্য ব্যবহার করা হয়, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কেননা, দেশে বর্তমানে হাঁস/মুরগির খাবারের চাহিদার পরিমাণ ৯৫ লাখ টন, গবাদিপশুর ১৪৫ লাখ টন, অথচ মোট ট্যানারির বর্জ্য হয় মাত্র ৮৫ হাজার টন।
মন্ত্রী বলেন, তুলনামূলকভাবে সারা পৃথিবীতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত উন্নত জাতের মুরগির মাংস আমিষসমৃদ্ধ ও সস্তা। ব্রয়লার মুরগির মাংস বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তা ও সহজলভ্য আমিষের উৎস। কিন্তু আমাদের দেশে মাথাপিছু মুরগির মাংস খাওয়ার পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। এর কারণ হলো ফার্মের মুরগির মাংস সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের নেতিবাচক ধারণা ও খাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে নাই বলে মানুষ মনে করে, ফার্মের মুরগির মাংসের স্বাদ কম। অনেক উচ্চবিত্তরা মনে করে, এটা গরীবের মাংস। তথাকথিত অনেক অভিজাতশ্রেণি অহংকার করে বলে, আমরা ফার্মের মুরগি খাই না। অথচ উন্নত বিশ্বের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সবচেয়ে বেশি আমিষ গ্রহণ করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত উন্নত জাতের মুরগির মাংস থেকে।
মন্ত্রী বলেন, দেশে ব্রয়লার মুরগি খুবই সম্ভাবনাময় একটি খাত। চাহিদা বৃদ্ধি করতে পারলে দেশে যে পরিমাণ খামার ও অবকাঠামো রয়েছে, তার পুরোপুরি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন আরো বহুগুণে বৃদ্ধি করা সম্ভব। সেজন্য, মানুষের কাছে মুরগির মাংস জনপ্রিয় করতে হবে। এটি করতে পারলে একদিকে আমিষের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে সুস্থ, সবল ও মেধাবী জাতি গঠন সহজতর হবে। অন্যদিকে, ব্রয়লার মুরগির বাজার দ্রুত বিকশিত হবে, মুরগির মাংস প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব হবে।