ব্যাগে ছিলো ১টি শার্ট, আর পকেটে ৩২০ টাকা

বাংলার পথিক:বাংলার পথিক:
প্রকাশিত: ৫:২২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৬, ২০২৩

২০০৮ সাল। আমি মাহবুব আর মিশা। আমরা তখন সবাই ভার্সিটির ছাত্র। মিডটার্ম পরীক্ষা শেষে ক্রিকেট খেলার কথা ছিলো আমার। আমি তাই ব্যাগে একটা এক্সট্রা টি-শার্ট নিয়েছি। আর গামছা আমার ব্যাগের পার্মানেন্ট বাসিন্দা। দুপুরে বনানী বিদ্যানিকেতন মাঠে খেললাম। এর আগে কিছু লেকচার শিট প্রিন্ট আর সাথে হালকা পাতলা আহার করে সেদিন ৫০০ টাকা ভাংতি করেছি। সবকিছুর বিল দিয়ে হাতে ছিলো ৩২০ টাকা। এমন সময় নর্থ সাউথের ক্যাম্পাস থেকে মাহবুবের ফোন এলো- তুমি কোথায়? আমি বললাম-বনানী। পাশে থেকে মিশার আওয়াজ, বললো চলো পালাই। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম” কি বলিস এখন কই পালাবো? মিশা বললো- চাচাতো বিরিশিরি চলো যাই। ট্রেনে যাব, অতো ভাড়া নাই, এক রাত সোমেশ্বরী নদীর পাড়ে আর এক রাত বিজয়পুর। আমি হাসলাম, বললাম টাকা নাই। ওরা বললো, তুমি রাতে বিমানবন্দর ট্রেন স্টেশনে আসবা, অতকিছু জানিনা।

আমি কোন রিপ্লে দেবার আগে ফোন কেটে দিলো। ব্যাপারটা মাথার উপর দিয়ে গেলো। বিকেলে ভার্সিটির কম্পিউটার ল্যাবে গিয়ে দেখে নিলাম বিরিশিরি আর সোমেশ্বরী আসলে কি? এগুলো বাংলাদেশের কোথায় অবস্থিত আর ঢাকা থেকেই বা কতো দূরে। দু চার টা ছবি পেলাম আর সামান্য কিছু তথ্য।

আমি মনে মনে ধরেই নিলাম যাবনা। ল্যাব থেকে বেরিয়ে কাকলী মোড়ে এসে বাসের অপেক্ষা করছি। হটাৎই একটা বিলবোর্ডে চোখ গেলো। গ্রামীণফোনের একটা কমিউনিকেশন নী গাড়ো পাহাড় থেকে একটা স্বচ্ছ নদী। কিছু মানুষ সেই নদীতে কি জেনো করছে। দূরে এক গুচ্ছ মেঘ। আমি আমার সাথে থাকা এক বন্ধুকে বললাম বাহ! যায়গাটা তো ভীষণ সুন্দর! এটা কি বাংলাদেশে। সে উওর দিলো এটা নেত্রকোনার সীমান্ত ঘেঁষা নদী সোমেশ্বরী। আমি বললাম তুই গিয়েছিস আগে? ও বললো নাহ! আমি সাথে সাথে মাহবুবকে ফোন দিলাম। মাহবুব

ফোন ধরেই বললো রাত সাড়ে আটটায় জামালপুর এর ট্রেন। রাস্তায় জ্যাম প্রচুর গাড়ী ধরে বিমানবন্দরে প্লাটফর্মের বাম দিকে ফ্লাইওভার, বলে লাইন কেটে দিলো। আমি আবার তাকালাম বিলবোর্ডের দিকে। ভাবলাম যা হবার হবে। লোকাল ৩ নম্বর বাসে কোনরকম ভিড় ঠেলে উঠা মাত্রই মাগরিবের আযান। গাড়ি তার আপন গতিতে ছুটে এম ই এস, শ্যাওড়া, হয়ে নিকুঞ্জ এলো। বসার চিন্তা বাদই দিলাম। ৫ টাকায় চলে এলাম এয়ারপোর্টে। পাক্কা আধাঘন্টা জীবন থেকে চলে গেলেও ওদেরকে জায়গা মতোন পেয়ে গেলাম। শুরু হলো আলাপ। প্রথমে মিশা বললো এই লোকাল ট্রেনে কোন টিকেট চেক হয় না। এগুলা মেইল। আমি বললাম- তাহলে কি আমরা জামালপুর যাচ্ছি। মিশা বললো- নাহ! ময়মনসিংহ নেমে যাচ্ছি। এরপর নেত্রকোনার জাড়িয়া পর্যন্ত আরেক মেইল ট্রেনে। আমি বললাম সেটাও কি ফ্রি। ও বললো না ভাড়া ৬ টাকা। মাহবুব আর আমি হাসলাম। তারপর আবার ক্যাম্পাস আর ক্যাম্পাসের কিছু মেয়েদের নিয়ে রসের আলাপ সেরে সিদ্ধান্ত নিলাম রাতের খাবার হালকা পাতলা খেয়ে নেবার। এদিকে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ভালোই শীত পড়েছে। আমি মিশাকে বললাম ক্যামন ভোগাবে শীত? উত্তর আসলো তেমন না। বাসায় একটা ফোন দিলাম। মাকে মিথ্যাটা বললাম না। ময়মনসিংহ যাচ্ছি ট্রেনে এটুকু কনফার্ম করলাম।

Nagad

এর কিছুক্ষণ পরই দিনাজপুর এর এক্সপ্রেস ট্রেন নীলসাগর প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালো। এর কিছুক্ষণ পর চট্টগ্রামের মহানগর প্রভাতি। আর তার পরপরই এলো জামালপুরের মেইল ট্রেনটি। আমি মিশা আর মাহবুবকে বললাম স্মৃতি ধারণের জন্য হলেও ৩ টা টিকেট নে। ৩০ টাকা করে ৯০ টাকা টিকেট নেয়া হলো। তারপর ট্রেনে উঠে সে এক ভয়ংকর অবস্থা। পুরো বগী বোঝাই মানুষ। লোকে লোকারণ্য আর জানতে পারলাম বিদ্যুৎ নেই। কোন রকম ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আমরা মাঝ বগীতে যার যার মোবাইল মানিব্যাগ এক হাতে চেপে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রেন টঙ্গী, জয়দেবপুর হয়ে এগুচ্ছে ভিড় আরো বাড়ছে। আর মিশা যে বলেছিলো শীত নেই তার এই কথার কোন দাম রইলো না। নিঝুম রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার আরপায়ের নিচেও বসে আছেন কিছু মা খালারা। আমি উপলব্ধি করছিলাম কেউ আমার পা দুহাতে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। প্রায় সারারাত এভাবে যেতে হবে ভেবে আমার ৩০ টাকার টিকিট কাটার দুঃখ কোনভাবেই যাচ্ছিলো না।

পরিশেষে কুয়াশা আর অন্ধকার ভেদ করে এলো গফরগাঁও স্টেশন। ট্রেনের ভীর প্রায় কমে অর্ধেক হয়ে গেলো। আমরা একটু ভালো সিট দেখে বসে পড়লাম। ৫ মিনিটের বিরতিতে আমি একটু দরজার পাশে গিয়ে বাইরে আর কিছু দেখা যায় কিনা চেষ্টা করলাম। কিন্তু না। কিছুই দেখার উপায় নাই কুয়াশা আর অন্ধকারে মনে হলো একটা জনস্রোত গিলে খেলো।

মাথায় তখন হিসাব ঘুরছে পকেটে আর আছে মাত্র ২৮৫ টাকা। মনে মনে ভাবলাম ওদের কাছে ধার নেবো। কিন্তু সেই মুহূর্তে ঘুমকেও ছুটি দিলাম। কারণ কুয়াশা ট্রেনের কু ঝিকঝিক শব্দ আর কানে গোজা শুভমিতার গান। উফ এক অদৃশ্য আনন্দ আমার চারিপাশটা উপভোগ্য করে তুলেছে! যদিও সে জীবনে কোন লাক্সারি ছিলোনা, যে কোন সময় যে কোন কিছু ঘটে যাবার ভয় ছিলো, কিন্তু তার মঝেও একটা অনুভূতি ছিলো। হয়তো সেটা বেচে থাকার অনুভূতি।

আমার চারপাশে নানান বয়সের মানুষের অবস্থান। কেউ কনকনে শীতে কাবু,কারো কিছুই হচ্ছে না। কেউবা ঘুমের দেশে হারিয়ে গেছে। রেলগাড়িটা বেজায় শব্দ করে ছুটছে। তার গতিতে মনে হলো সে আর থামবেই না। এভাবেই চলতেই থাকবে চলতেই থাকবে.. ভাবতে ভাবতে নিজেই আর দশ জনের মতো ঘুমের দেশে চলে গেলাম। মিশা যখন ডেকে তুললো তখন আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম ময়মনসিংহ রেল স্টেশনে। একটি বারের জন্য মনে হলো ট্রেন টি আমাদের ৩ জনকে অচেনা এক দ্বীপে ফেলে চলে গেলো। কুয়াশায় কিচ্ছু দেখার সুযোগ নেই। তার মাঝেই ব্যতিক্রম একটা চায়ের দোকান। সেই ভীষণ ঠাণ্ডায় চাকে না বলাটা কঠিন, কিন্তু চায়ে চুমুক দিয়ে বুঝলাম ঠাণ্ডা শরবত খাচ্ছি। একজন বয়স্ক মানুষের সাথে কথা বলে ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে যাওয়া নেত্রকোনার জাড়িয়া যাবার ট্রেন খুঁজে তার কামড়ায় আশ্রয় নিলাম। ঠিক ভোর ৫ টায় ট্রেন ছেড়ে দিলো। আমি ততক্ষণে শীতে কাবু, তাই আবারো ঘুমিয়ে গেলাম। ঘণ্টা দুই পার হলো।

হটাৎ মাহবুব ডাক দিলো। জানালায় তখন রোদের হাতছানি। ট্রেন এতটাই দ্রুত যাচ্ছে যে পাশের রাস্তা দিয়ে স্কুল ছাত্ররা সাইকেল চালিয়ে ট্রেনের আগে যাচ্ছে। তবে গ্রামীণ জীবন, বিস্তীর্ণ সরিষা ফুলের ব্যাগে ছিলো মাত্র ১ টা গেঞ্জি আর পকেটে ৩২০ টাকা।

এর কিছুক্ষণ পরই দিনাজপুর এর এর কিছুক্ষণ পরই দিনাজপুরেরএর এক্সপ্রেস ট্রেন নীলসাগর প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালো। এক্সপ্রেস ট্রেন নীলসাগর প্লাটফর্ম এ এসে দাঁড়ালো। এর কিছুক্ষণ পর চট্টগ্রাম এর মহানগর প্রভাতি। আর তার পরপরই এলো জামালপুরের মেইল ট্রেনটি। আমি মিশা আর মাহবুব কে বললাম স্মৃতি ধারণের জন্য হলেও ৩ টা টিকেট নে। ৩০ টাকা করে ৯০ টাকা টিকেট নেয়া হলো। তারপর ট্রেনে উঠে সে এক ভয়ংকর অবস্থা। পুরো বগী বোঝাই মানুষ। লোকে লোকারণ্য আর জানতে পারলাম বিদ্যুৎ নেই। কোন রকম ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আমরা মাঝ বগীতে যার যার মোবাইল মানিব্যাগ এক হাতে চেপে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।

ট্রেন টঙ্গী,জয়দপপুর হয়ে এগুচ্ছে ভীর আরো বাড়ছে। আর মিশা যে বলেছিলো শীত নেই তার এই কথার কোন দাম রইলো না। নিঝুম রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর পায়ের নিচেও বসে আছেন কিছু মা খালারা। আমি উপলব্ধি করছিলাম কেউ আমার পা দুহাতে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। প্রায় সারারাত এভাবে যেতে হবে ভেবে আমার ৩০ টাকার টিকিট কাটার দুঃখ কোনভাবেই যাচ্ছিলো না। পরিশেষে কুয়াশা আর অন্ধকার ভেদ করে এলো গফরগাঁও স্টেশন। ট্রেনের ভীর প্রায় কমে অর্ধেক হয়ে গেলো। আমরা একটু ভালো সিট দেখে বসে পড়লাম। ৫ মিনিটের বিরতিতে আমি একটু দরজার পাশে গিয়ে বাইরে আর কিছু দেখা যায় কিনা চেষ্টা করলাম। কিন্তু না। কিছুই দেখার উপায় নাই কুয়াশা আর অন্ধকারে মনে হলো একটা জনস্রোত গিলে খেলো।

মাথায় তখন হিসাব ঘুরছে পকেটে আর আছে মাত্র ২৮৫ টাকা। মনে মনে ভাবলাম ওদের কাছে ধার নেবো। কিন্তু সেই মুহূর্তে ঘুমকেও ছুটি দিলাম। কারণ কুয়াশা ট্রেনের কু ঝিকঝিক শব্দ আর কানে গোজা শুভমিতার গান। উফ এক অদৃশ্য

আনন্দ আমার চারিপাশটা উপভোগ্য করে তুলেছে! যদিও সে জীবনে কোন লাক্সারি ছিলোনা, যে কোন সময় যে কোন কিছু ঘটে যাবার ভয় ছিলো, কিন্তু তার মাঝেও একটা অনুভূতি ছিলো। হয়তো সেটা বেচে থাকার অনুভূতি। আমার চারপাশে নানান বয়সের মানুষের অবস্থান। কেউ কনকনে শীতে কাবু,কারো কিছুই হচ্ছে না। কেউবা ঘুমের দেশে হারিয়ে গেছে। রেলগাড়িটা বেজায় শব্দ করে ছুটছে। তার গতিতে মনে হলো সে আর থামবেই না। এভাবেই চলতেই থাকবে চলতেই থাকবে.. ভাবতে ভাবতে নিজেই আর দশ জনের মতো ঘুমের দেশে চলে গেলাম। মিশা যখন ডেকে তুললো তখন আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম ময়মনসিংহ রেল স্টেশনে। একটি বারের জন্য মনে হলো ট্রেন টি আমাদের ৩ জনকে অচেনা এক দ্বীপে ফেলে চলে গেলো। কুয়াশায় কিচ্ছু দেখার সুযোগ নেই। তার মাঝেই ব্যতিক্রম একটা চায়ের দোকান। সেই ভীষণ ঠাণ্ডায় চাকে না বলাটা কঠিন, কিন্তু চায়ে চুমুক দিয়ে বুঝলাম ঠাণ্ডা শরবত খাচ্ছি। একজন বয়স্ক মানুষের সাথে কথা বলে ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে যাওয়া

নেত্রকোনার জাড়িয়া যাবার ট্রেন খুঁজে তার কামড়ায় আশ্রয় নিলাম। ঠিক ভোর ৫ টায় ট্রেন ছেড়ে দিলো। আমি ততক্ষণে শীতে কাবু, তাই আবারো ঘুমিয়ে গেলাম। ঘণ্টা দুই পার হলো। হটাৎ মাহবুব ডাক দিলো। জানালায় তখন রোদের হাতছানি। ট্রেন এতটাই দ্রুত যাচ্ছে যে পাশের রাস্তা দিয়ে স্কুল ছাত্ররা সাইকেল চালিয়ে তার আগে চলে যাচ্ছে। এমন যখন পরিস্থিতি চলছে কোন এক যাত্রী বললেন এই ট্রেন লাইনে কোন পাথর নেই! শুধু লাইনটা টিকে আছে।

কলমাকান্দা এসে ট্রেনের ৬ টাকা ভাড়া পরিশোধ করে এবার বাইরে ভালো করে তাকালাম। এরই মাঝে ধরা দিলো সুমেশ্বরী সেই নদী। কিছু মানুষ নদীতে ডুব দিয়ে কি জেনো করছে। ট্রেনে থেকে খুব একটা বোঝা গেলো না। আমরা সকাল ৯ টায় পৌছুলাম জারিয়া। সেখান থেকে একটি ছোট্ট খাল পেরিয়ে লোকাল বাসে চরে নামলাম বিরিশিরি। সুমেশ্বরী নদী এখনে অসাধারণ, বিরিশিরি থেকে রানীখং এখানে একটি বড় ব্রিজ। আর রাস্তার দু পাশে বিশাল বিশাল রেইন ট্রি। কি অসাধারণ সেই সৌন্দর্য। আমাদের মনোবল ছিলো

অটুট কিন্তু শারীরিক ক্লান্তি দূর৷ করতে প্রয়োজন হলো বিশ্রামের। সকালের নাস্তা সারলাম জনপ্রতি ৪০ টাকা সুমেশ্বরী নদীর ছোট মাছের তরকারি টমেটো সালাত ইত্যাদি দিয়ে। আমার পকেটে ব্যালেন্স মাত্র ২৪৫ টাকা। আমরা একটি YMCA নামক সামাজিক সংগঠন খুঁজে পেলাম। সেখানে তাদের ২ তলায় বিশ্রামাগার রয়েছে। আমাদের রুমের ভাড়া নিলো ২০০ টাকা। দুইটা সিঙ্গেল বেডে একটাতে মিশা মাহবুব আর একটাতে পুরাটা আমি। ওরা দিলো ১৪০ টাকা আমি দিলাম ৬০, তারপর গোসল দিয়ে ঠাণ্ডায় লেপ গায়ে সবাই ঘুম দিলাম।

বিকাল ৩ টায় সবাই উঠলাম। এরপর ফ্রেশ হয়ে ব্যাগে থাকা লাস্ট গেঞ্জিটা গায়ে দিয়ে বের হলাম সুমেশ্বরী নদী দেখতে। আমরা ব্রিজের পাশ থেকে সোজা নেমে গেলাম। যতই আমি নদীর দিকে আগাই ততই রাস্তায় কখনো কাচ বালু কখনো ছোট বড় মাঝারি নানান আকৃতির পাথর। ঠিক ১০ মিনিট পরে আমরা নদীর পাড়ে পৌছাই। এবং অবাক হয়ে দেখি নদীর পানি কাচের মতোই স্বচ্ছ এবং তলা দেখা যায়। আমি নিজেকে কন্ট্রোল

করতে পারলাম না। নেমে গেলাম স্বচ্ছ সুন্দর সোমেশ্বরী নদীতে। মজার বিষয় হলো আমরা পায়ে হেটেই নদীটা পার হয়ে গেলাম। মেঘালয় থেকে নেমে আসা বালু, পাথর আর কয়লায় টইটম্বুর সুমেশ্বরীর তলদেশ। তবে বেশ স্রোত আছে। আছে ঠাণ্ডা পানির দারুণ অনুভব। সেখানেই আবিষ্কার করলাম ডুবে ডুবে কয়লা তোলার এক ব্যতিক্রমী পেশার মানুষদের। আমি প্রকৃতি আর চারিপাশের পরিবেশ দেখেই দুপুরের খাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। মনে করিয়ে দিলো মিশা আর মাহবুব। আমরা রানিখং বাজারে গেলাম। নদীর পাড় ধরে হেটে হেটে চলে গেলাম। সেখানে পেলাম স্থানীয় বাগানের মালটা আর এক প্রকার পিঠা। মাত্র জনপ্রতি ১৫ টাকা খরচে পেট ভরে গেলো। রাতের জন্য পাউরুটি জ্যাম কলা আর সিদ্ধ ডিম নিলাম। খরচ আসলো জনপ্রতি ৩৫। এরপর গোধুলীর সময়টা নদীর পাড়ে গিয়ে দূরে মেঘালয় পাহাড় দেখে কাটিয়ে দিলাম। প্রায় রাত করে আমরা হাটতে হাটতে ফিরলাম বিরিশিরি YMCA. তাদের রিসিপশন আমাদেরকে কয়েল আর পানি দিয়ে গেলো। রুমে বসে আমরা সবাই অনেক

আড্ডা দিলাম। সকালে কই কই যাবো তা ভেবে নিলাম। আমি মনে মনে ভাবছিলাম বাসায় কি করে ফিরব, কালকেও যদি ঘুরি তাহলে পকেট তো নিশ্চিত ফাকা হবেই। যাই হোক আড্ডা রাত গড়ালো। রাতে সবাই ডিনার করে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে আমরা নাস্তা করলাম বিজয়পুর যাবার খেয়া ঘাটে। ৩ জনের লাগলো ২০ টাকা করে ৬০ টাকা। ২ টা রুটি একটা সবজি। অনেক ভালো নাস্তা ছিলো। রং চা ও খেলাম। এরপর মিশা শুরু করলো রিকশাওয়ালা এক মামার সাথে ব্যাপক দর কশাকশি। চুনাপাথর, বিজয়পুর সীমান্ত আর বিজিবির হ্যালিপ্যাড ১২০ টাকা আপডাউন। আমরা ৯০ টাকায় দফারফা করলাম। কারণ আর কোন পর্যটক নেই সেখানে। এরপর আমাদের সুখের জেনো শেষ নেই। পুরো পথটা মেঠো পথ আর অনেক সুন্দর। খানিক বাদেই এলো একটা কমলা রঙ এর মন্দির। আর তারপরেই আমাদের রিকসা মোড় নিলো বা দিকে। কিছুদূর যেতেই উঁচু ঢিবির মতো চোখে পড়লো। আরো কাছে গিয়ে বুঝলাম এটা ঢিবি নয়, চুনাপাথরের বিশাল পাহাড়। আমাদের আনন্দের সীমা রইলোনা।

ভালো করে চারিপাশটা ঘুরে নিলাম। এখানেও রয়েছে স্বচ্ছ জলের লেক। স্থানীয়রা আমাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমরা নানান স্টাইলে তখন ছবি তোলায় মগ্ন। যদি শীতকাল না হতো তবে কেউ আমাকে পানিতে নামা থেকে আটকাতে পাড়তো না। আমরা এরপর আবার রিক্সায় চড়ে পৌছুলাম বিজিবি ক্যাম্প। সেখানে অনুমতি নিয়ে একটা টিলায় উঠে গেলাম। তারপর যা দেখলাম চোখে বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম বনানীতে যে বিশাল বিলবোর্ডের ছবিটা সেই ছবিটাই আসলে বাস্তবে দেখছি। মেঘালয় পাহাড় গুলোর এক একটি উঁচু হয়ে আকাশে মিশে গেছে। অসাধারণ, অনন্য সুন্দর সুমেশ্বরী তার মাঝখান থেকে বিপুল রত্নভাণ্ডার বয়ে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। আমরা পায়ে হেটে হ্যালিপ্যাডে নামলাম আর ছবি তুললাম। খানিকবাদে কিছুদূর আরো ঘুরে পুনরায় সীমান্ত ক্যাম্পের চেকপোস্ট চলে এলাম। এবার ফেরার পালা। প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে জোহরের নামাজের কিছুটা আগে বিরিশিরি চলে এলাম। আমরা সকালেই YMCA থেকে একবারেই ব্যাগসহবেরিয়ে গিয়েছিলাম।
রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষা করছি যদি ঢাকার কোন সরাসরি সার্ভিস পাই। এমন সময় একটি রিটার্ন মাইক্রো আমাদের ময়মনসিংহ নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিলো। আমরা প্রথমে বললাম টাকা নাই, ১৫০ দিতে পারবো,স্বপ্নেও ভাবিনি সে রাজি হয়ে যাবে। আনন্দচিত্তে এসি মাইক্রোতে গান শুনতে শুনতে চলে এলাম নিমিষে ময়মনসিংহ। ভাগ্য সহায় ছিলো আলহামদুলিল্লাহ।

এরপর আমাদের ময়মনসিংহ মেডিকেলের সামনে আবার একটি বাস উঠিয়ে নিলো। নিয়েই সোজা ঢাকার রাস্তায় টান। আমি একটু পিছনে আর ওরা সামনে সিট পেলো। এরপর জানালা হতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আর পুরো পথের জার্নির কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম যখন ভাংলো তখন টঙ্গি ব্রিজ পার হচ্ছি। মাহবুব আর মিশা আবদুল্লাহপুর নেমে গেলো। আমি রইলাম একা। হটাৎ খেয়াল হলো কি ব্যাপার এতক্ষণ হয়ে গেছে কেউ ভাড়া চাইলোনা? মনে মনে ভাবলাম একবার বাসের কন্টেকটারকে জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু পরক্ষনেই আর সাহসটা করলাম না।

ঠিক মাগরিবের আযানের সময় বনানীর সৈনিক ক্লাব এসে নামলাম। তারপর পায়ে হেটে বাসার দিকে রওনা দিলাম। মাহবুবকে ফোন দিলাম বললাম বাস ভাড়া কত দিয়েছিস, বললো ২৪০ টাকা। অর্থাৎ এক একজনের ভাগে ৮০ টাকা। এভাবেই সমাপ্ত হলো আমাদের নেত্রকোনার বিরিশিরি যাত্রা। এখনো ভাবি কি করে এতোটা পথ আমরা এতো সস্তায় পাড়ি দিলাম। মানুষের ছোটবেলার সবকিছু হয়তো মনে থাকেনা, কিন্তু ঘোরাঘুরি, বেড়ানোর স্মৃতি সে কোনদিনও ভোলেনা। আজো স্মৃতিতে অম্লান আমাদের সেই দিনগুলি।

পরিশেষে কবির ভাষায় বলতে হয়-

জীবন পালটে গেছে স্মৃতিগুলো রেখে
আজো আমি ঘুরে ফিরি তারে দেখে দেখে