বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীর নিবাস’ নির্মাণে অনিশ্চয়তা, ঠিকাদারদের অনাগ্রহ

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীর নিবাস’ নির্মাণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ঠিকাদারেরা এ কাজে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। যার ফলে এক পর্যায়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীর নিবাস। জীর্ণশীর্ণ ভাঙা ঘরে বসবাসরত অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার একসময় পাকা ঘরের স্বপ্ন দেখতেও সাহস পেতনা। তাদের মনে স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরিত ও প্রস্ফুটিত করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর মহানুভবতায় সরকার জীর্ণশীর্ণ ভাঙা ঘরে বসবাসরত সেই অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের উত্তরাধিকারদের জন্য আবাসন নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ‘বীর নিবাস’ নির্মাণ শুরু করেছে ।

ভূমিহীন ও অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনয়নে কাজ করছে সরকার । অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা বাছাই কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। অসচ্ছল বীরাঙ্গনারা সরাসরি বরাদ্দ পাবেন। অসচ্ছল যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রাধিকার পাবেন। অগ্রাধিকার পাবেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার অসচ্ছল স্ত্রী-সন্তানেরা। বাড়ির সামনে নামফলক। নামফলকে লেখা ‘বীর নিবাস’।

অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও প্রয়াত যুদ্ধ বীরদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ‘বীর নিবাস’ নামের এই আবাসন প্রকল্প। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় ৩০ হাজার বাড়ি নির্মাণ করা হবে। প্রতিটি নিবাসের আয়তন ৭৩২ বর্গফুট। একতলার এই বাড়িতে দুটি শয়নকক্ষ বেড রুম) , একটি বসার কক্ষ (ড্রয়িংরুম), একটি খাওয়ার কক্ষ (ডাইনিং),একটি রান্নাঘর (কিচেন) , একটি প্রশস্ত বারান্দা ও দুটি শৌচাগার থাকছে। প্রতিটি বাড়িতে থাকছে একটি উঠান, একটি নলকূপ, গবাদি পশু-হাঁস-মুরগি পালনের জন্য পৃথক শেড। প্রতিটি বাড়ির ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ লাখ ১০ হাজার টাকা।

প্রধানমন্ত্রী গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৫ হাজার ‘বীর নিবাসের’ চাবি হস্তান্তরের উদ্বোধন করেছেন। তবে দ্বিতীয় পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত রেটের চেয়ে বাজারে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য অতিরিক্ত হওয়ায় বরিশালের বানারীপাড়া ও উজিরপুর উপজেলায় কাজ করতে চান না কোনো ঠিকাদার। এই অবস্থায় আটকে গেছে দ্ইু উপজেলায় ১৫৯ উপকারভোগীর স্বপ্নের ঘর ( বীর নিবাস ) নির্মাণকাজ। প্রথম পর্যায়ে এ দুই উপজেলায় বীরনিবাস নির্মাণ করা গেলেও দ্বিতীয় ধাপে বীর নিবাসের নির্মাণ কাজ করা যাচ্ছে না। বানারীপাড়া উপজেলায় দ্বিতীয় পর্যায় ৪৮টি ঘর নির্মাণ কাজের কার্যাদেশ দেওয়ার ৪ মাসেও ঠিকাদাররা কাজ শুরু করেননি । অপরদিকে উজিরপুরে ১১১ টি বীর নিবাস নির্মাণের জন্য টেন্ডার আহবান করা হলেও কেউ দরপত্র ক্রয় করেনি ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ সালের পিডব্লিউডির করা সরকারি রেট অনুযায়ী বীর নিবাসের দরপত্রে ইট ৮ টাকা ৫০ পয়সা, রড ৮২ টাকা, সিমেন্ট ৪২০ টাকা ধরা হয়েছে । কিন্তু বর্তমানে (চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরে) বাজারে ইট পরিবহন খরচসহ সাড়ে ১২ হাজার টাকা, রড ৯২ টাকা, সিমেন্ট ৫৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে । এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অন্যান্য খরচও । নির্মাণ সামগ্রীর অতিরিক্ত মূল্য ও কাজের বিল প্রাপ্তিতে ভোগান্তিসহ নানা কারণে টিকাদারদের এ কাজে আগ্রহ নেই ।

এ বিষয়ে বানারীপাড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) প্রকৌশলী মহসিন-উল হাসান জানান বানারীপাড়া উপজেলায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬ টি প্যাকেজে ৪৮টি বীর নিবাস নির্মাণের জন্য গত বছরের ৮ অক্টোবর দরপত্র আহবান করা হয় । ৩০ অক্টোবর দাখিলের পরে ২৪ নভেম্বর মেসার্স তাহসিন এন্টারপ্রাইজ,মেসার্স রুমা ব্রিকস,মেসার্স তাসলিমা ব্রিকস,মেসাস আঞ্জুমানারা নির্মাণ,মেসার্স নুসরাত এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স শুভ এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেওয়া হয় ।

Nagad

গত চারমাসেও তারা কাজ শুরু না করায় বার বার লিখিত ও মৌখিক তাগাদা দেওয়ার পরে সম্প্রতি মেসার্স শুভ এন্টারপ্রাইজ ৬টি ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। বাকীগুলো কবে নাগাদ সম্পন্ন হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

এ ব্যপারে উজিরপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) প্রকৌশলী অয়ন সাহা জানান, তার উপজেলায় ১১১টি বীর নিবাস নির্মাণের জন্য গত বছরের ১৪ জুন দরপত্র আহবান করা হয়েছিল । ৪ জুলাই ছিল দাখিলের তারিখ কিন্তু কেউ দরপত্র ক্রয় করেনি । ফলে এ উপজেলায় বীর নিবাস নির্মাণ কাজ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে । তিনি ব্যক্তিগতভাবেও অনেক ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কিন্তু বীর নিবাস নির্মাণে সবাই অনাগ্রহ দেখিয়েছেন জানিয়ে বলেন, বিল প্রাপ্তিতে ভোগান্তি ও নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে ঠিকাদারদের এ কাজ নেওয়ার বিষয়ে অনীহা রয়েছে।

এদিকে ঠিকাদাররা জানান,সরকারি রেট অনুযায়ী কাজ করতে গেলে লাভ তো দূরের কথা বরং প্রতিটি ঘরে তাদের দেড়-দুই লাখ টাকা লোকসান গুনতে হবে। নির্মাণ সামগ্রীর দর কমার আশায় তারা অপেক্ষায় থাকায় কাজ শুরু করছেন না বলেও জানান । তারা প্রাক্কলন ব্যয় পুনঃ মূল্যায়নের দাবি জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতিমা আজরিন তন্বী বলেন, দ্রুত বীর নিবাস নির্মাণ কাজ সম্পন্ন না করলে ঠিকাদারদের কার্যাদেশ বাতিলসহ পিডির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এদিকে উপকার ভোগী অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজনরা জানান, প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতায় তারা জীর্ণশীর্ণ ভাঙা ঘর থেকে একটি পাকা ঘরে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন । তবে তাদের অপেক্ষার প্রহর যেন দীর্ঘ না হয় । বিশেষ করে অশীতিপর বৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ ও মৃত মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রীরা জীবদ্দশায় যেন স্বপ্নের পাকা ঘরে বসবাস করে যেতে পারেন সেই দাবি তাদের । তা না হলে আফসোস নিয়ে কবরে যেতে হবে জানিয়ে বলেন, মরণের পরে পাকা ঘর করে দিলে তাতে কি লাভ হবে তাদের ?