সাত মার্চ ও বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত দ্বিতীয় বিপ্লব

সাত মার্চ বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিপ্লবের স্বাক্ষবহ। বাংলাদেশকে স্বাধীন করায় বঙ্গবন্ধুর দুই যুগের যে পথ পরিক্রমা তার ঘটনাবহুল ক্যালেন্ডারে সর্বশেষ ল্যান্ডমার্ক এই তারিখটি। এই দিন ঐতিহাসিক রেসকোর্সে লক্ষ লক্ষ মানুষের জনসমুদ্রে দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন চূড়ান্ত অসহযোগ আর মুক্তির সংগ্রামের। একাত্তরের রক্তঝড়া ন’টি মাসে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর তিন লক্ষ বিরঙ্গনার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের পথ বেয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। তবে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পথ চলা মোটেও মসৃন ছিল না। এদেশটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সৃষ্টি। এই দেশের নাম, এর জাতিয় শ্লোগান আর এমনকি জাতিয় সঙ্গীতটি পর্যন্ত তার নির্ধারণ করে দেওয়া। তার প্রথম বিপ্লবের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশকে তিনি একেবারে অঙ্কুর থেকে সযত্নে লালন করে মহীরূহুতে পরিণত করেছিলেন। আর এই প্রক্রিয়ায় তিনি অসন্তোষভাজন হয়েছিলেন পৃথিবীর অধিকাংশ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর। একাত্তরে পাকিস্তান ছিল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম সামরিক শক্তি। সার্বক্ষণিক ইসরায়েলি হুমকি-ধামকির মধ্যে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো পাকিস্তানকে দেখতো তাদের অন্যতম খুটি হিসেবে। চীনের কাছে দেশটি ছিল চির বৈরি ভারতকে শায়েস্তায় রাখার অন্যতম করিডোর আর চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘পিংপং ডিপ্লোমেসি’ তার কেন্দ্রবিন্দুতেও ছিল পাকিস্তানি। কাজেই বাংলাদেশের কাদামাটিতে পাকিস্তানের ভড়াডুবি এদের কারো কাছেই স্বস্তিদায়ক ছিল না। শুরু থেকেই তারা বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে অকার্যকর আর ব্যর্থ প্রমাণে সচেষ্ট ছিল। স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা প্রাপ্তি, জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ কিংবা সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি, এত কিছুর পরও বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে প্রান দিয়ে তাই এসব বিরাজভাজন শক্তির অসন্তোষের মূল্য দিতে হয়েছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই কালো রাতে গুটিকয়েক সেনা কর্মকর্তাকে আমরা সামনে দেখেছি। নেপথ্যে ছিল আরো অনেকে আর ছিল এই সব বৈরি শক্তিগুলো, যাদের বেশির ভাগই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর।

বঙ্গবন্ধু তার প্রথম বিপ্লবটি সফল করে যেতে পেরেছিলেন। সময় পাননি দ্বিতীয় বিপ্লবের সফল বাস্তবায়নের। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল এমন একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা যেখানে থাকবে সমাজতন্ত্র আর শোষিতের গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ছিল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন আর মাওসেতুংয়ের সমাজতন্ত্রের চেয়ে ভিন্ন ধারার। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে দেশজ ও গণতান্ত্রিক সমজাতন্ত্র। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণ যাদের নির্বাচন করবে তারাই সরকার চালাবে। শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়। শক্তির উৎস হলো জনগণ’। পাশাপাশি তার শোষিতের গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সেটিও ছিল লেনিন কিংবা কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে একেবারেই অন্যরকম। ১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর জাতিয় সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের আপত্তি শুধু এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না’।

১৯৭০ সালের জাতিয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে ভূমিধ্বস বিজয় তার ম্যান্ডেট ছিল পাচ বছরের। তারপরও স্বাধীন দেশে ৭৩’এ আরেকটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে তিনি তার সেই ম্যান্ডেটটি পুনরায় যাচাই করে নিয়েছিলেন। জাতিয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এককভাবে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাংবিধানিক বৈধতা ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। তারপরও তার দ্বিতীয় বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি সাথে নিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং শক্তিকে। ‘বাকশালের বাংলাদেশে’ নির্বাচন নিষিদ্ধ হয়নি, নিষিদ্ধ হয়নি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বাচনী প্রচারণায় সমান সুযোগ ছিল প্রত্যেক নির্বাচনী পদপ্রার্থীর আর সেই সুযোগে নেতাকে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছিলেন স্কুল শিক্ষকও। জেলা গর্ভনরদের নেতৃত্বে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার আর উপজেলা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকৃত আইন অবকাঠামোর সুফল যদি পচাত্তরে বাংলাদেশ পেত, তাহলে গ্রামকে শহর দেখার জন্য আমাদের যেমন এখনও অপেক্ষায় থাকতে হতো না, তেমনি উন্নত দেশের স্বীকৃতি পেতে আমাদের অপেক্ষার প্রহর গুণতে হতো না ২০৪১ অবধি।

আজ যখন আবার সঠিক পথে বাংলাদেশ তখন আবারো সক্রিয় বাংলাদেশবিরোধী শক্তি। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে নিয়ে এদের আমরা বিভ্রান্তি ছড়াতে দেখেছি, ঠিক যেমন এদের পূর্বসূরীরা ছিয়াত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে দাবি তুলেছিল বাংলাদেশের নাম, জাতিয় পতাকা আর জাতিয় সঙ্গীত পরিবর্তনের। এরাই কদিন আগে ভ্যাকসিন বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে আর এখন পদযাত্রা আর… বাংলাদেশের ধুয়া তুলে হামলে পড়ছে পুলিশের উপর। ওদের অনলাইনের প্রপাগান্ডা ভিডিওগুলো দেখেছেন? দেখবেন পাশ্চাত্য আর প্রাচ্যের কি সুনিপুন যৌথ প্রযোজনা, সাথে গুটি কয়েক বাংলাদেশি দালাল। ঠিক যেন পঁচাত্তরের ঘৃণ্য নাটকটির ক্ষুদ্র মঞ্চায়ন। ৭ মার্চকে সামনে রেখে আজ যখন আবারো পাকিস্তানি দোসরদের দেখি মাঠ গরম করতে, তখন বড্ড বেশি বিবমীষা হয়। আর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত দ্বিতীয় বিপ্লবের বাস্তবায়নটা যে কতটা জরুরি সে কথাটা খুব বেশি মনে পড়ে।

লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

Nagad