লিঙ্গ পরিবর্তন করে যুবকের সাথে প্রেম, অতঃপর খুন

সাভার প্রতিনিধি:সাভার প্রতিনিধি:
প্রকাশিত: ৩:০৯ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৯, ২০২৩

আশুলিয়ার এনায়েতপুর থেকে দুই বছর আগে উদ্ধার হওয়া বস্তাবন্দী অজ্ঞাত লাশের পরিচয় নিশ্চিত ও এর রহস্য উদঘাটনসহ হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। লিঙ্গ পরিবর্তন করে বসবাসের সময় সম্পর্কের বিরোধের জেরে হত্যা করা হয় ওই যুবককে। এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে গিয়ে আরও চাঞ্চল্যকর বিষয় লিঙ্গ পরিবর্তনকারী চক্রের সন্ধান পায় পিবিআই।

বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেন পিবিআই এর ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মোঃ কুদরত-ই- খুদা।

এর আগে গত ১৭ অক্টোবর রাতে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানা এলাকার হিজড়া পল্লী থেকে হত্যাকারী চম্পা হিজড়াকে গ্রেফতার করা হয়।

হত্যাকারীর নওশাদ ওরফে চম্পা ওরফে স্বপ্না জামালপুর জেলার সদর থানার জামতলী এলাকায় বাসিন্দা। সে আগে পুরুষ থাকলেও ডাক্তারের মাধ্যমে সে একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হয়ে যায়।

নিহত ব্যক্তির নাম মোঃ রাকিব হাসান শাওন। সে বরগুনা জেলার বামনা থানার ভাইজোড়া এলাকার মোঃ শাহ আলমের ছেলে।

প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, ২০২১ সালের ৭ জুন সকালে আশুলিয়ার এনায়েতপু এলাকার একটি ফাঁকা জমি থেকে বস্তাবন্দী অজ্ঞাত ব্যক্তির (৩৫) অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছিল, অজ্ঞাতনামা হত্যাকারীরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে লাশ গুম করার লক্ষ্যে ঘটনাস্থলে বস্তা ভর্তি করে ফেলে রাখে। পরে এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।

Nagad

ঘটনার দুই মাস পরে মামলাটির তদন্তভার পিবিআইযের কাছে হস্তান্তর করা হলে তারা লাশের পরিচয় সনাক্ত সহ রহস্য উদঘটনের লক্ষ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন।

তদন্তের এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়া চম্পা পলাতকের বিষয়টি নজরে আসে তাদের। যার পূর্বের নাম নওশাদ। পিতা-মাতা না থাকা সত্ত্বেও লাশ পাওয়ার পরের দিন পিতার অসুস্থতার কথা বলে নওশাদ ওরফে চম্পা হিজড়া বাসা ত্যাগ করে গ্রামে চলে যাওয়া তদন্তকারী কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। তাকে খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে নিহতের ঠিকানা পাওয়া যায়। নিহতের পিতার সাথে যোগাযোগ করলে সে জানায় তার ছেলে রাকিব ঢাকার আগুলিয়ায় এক হিজড়ার সাথে বসবাস করে। কিন্তু কোথায় থাকে সেই ঠিকানা তিনি বা পরিবারের কেউ জানেন না।

পরে রাকিবের নামে রেজিষ্ট্রেশনকৃত একটি মোবাইল নম্বর এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান এই নম্বরটি তার ছেলে রাকিব ব্যবহার করে। কিন্তু লাশের ছবি দেখালেও তিনি তার ছেলের লাশ সনাক্ত করতে পারে নাই। পরবর্তীতে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, আশুলিয়ায় পাওয়া অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশই তার সন্তান রাকিব হাসান শাওন।

তদন্তকারী কর্মকর্তা মোঃ আনোয়ার হোসেন এর নেতৃত্বে পিবিআই ঢাকা জেলা একটি টিম ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে নওশাদ ওরফে চম্পা হিজড়াকে গ্রেফতারের লক্ষ্যে তার গ্রামের ঠিকানায় অভিযান পরিচালনা করেন। পরে গাইবান্ধা জেলার হিজড়া পল্লিতে অভিযান পরিচালনার করে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ৭ দিনের পুলিশ রিমাণ্ডের আবেদন পূর্বক তাকে বিজ্ঞা আদালতে সোপর্দ করা হলে বিজ্ঞ আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

জিজ্ঞাসাবাদে আসামী নওশাদ চম্পা ওরফে স্বপ্না জনায়, সে জন্মগত ভাবে হিজড়া ছিল না। সে বিবাহিত পুরুষ এবং নাম ছিল নওশাদ। তার ১২ বছর বয়সী আকাশ নামের একজন পুত্র সন্তান আছে। প্রায় ১১ বছর আগে তার স্ত্রী মারা যায়। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সে কর্ম বিমুখ হয়ে বেকার জীবন যাপন করতে থাকে এবং হতাশ হয়ে পড়ে। স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছু দিন পর তার সাথে দেলু হিজড়ার পরিচয় হয়। দেলু হিজড়া নওশাদকে হিজড়া হওয়ার প্রস্তাব দেয় এবং বলে হিজড়া হলে সে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারবে। দেলু হিজড়ার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নওশাদ হিজড়াদের দলে যোগ দেয়।

এর দেড় বছর পর দেলু হিজড়ার কথামত খুলনার লোহাপাড়ায় একজন ডাক্তারের মাধ্যমে অপারেশন করে মেয়ে হিজড়া হয়। সে ডাক্তার অনেক লোককে অপারেশন করে হিজড়া বানিয়েছে। হিজড়া হওয়ার পরে নওশাদ তার নাম পরিবর্তন করে চম্পা নাম ধারণ করে দেলু হিজড়ার অধীনে ৪/৫ বছর কাজ করে।

পরবর্তীতে সে ঢাকার আগুলিয়ার এনায়েতপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করে। আশুলিয়ার এনায়েতপুরে বসাবাসকালে নিহত রাকিব হাসান শাওনের সাথে তার পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ওঠে এবং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা একসাথে ভাড়া বাসায় বসবাস করতে শুরু করে। নিহতের খরচ চম্পা বহন করতো। ২০২১ সালে ১লা জুন ভিকটিম রাকিব তার নিকট ১ হাজার টাকা চায়। টাকা না দেওয়ায় নিহত রাকিব তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। পরে রাকিব ওষুধ কেনার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে কিন্তু যাওয়ার সময় তার মোবাইল ফোনটি বাসায় রেখে যায়। ঐ সময় নিহতের মোবাইলে রিপা নামের অন্য একজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি ফোন করে। চম্পা ফোনটি রিসিভ করে জানতে পারে, রিপার সাথেও রাকিবের প্রেমের সম্পর্ক সহ শারিরীক সম্পর্ক রয়েছে।

ওষুধ কিনে রাকিব বাসায় ফিসে আসলে চম্পা নিহত রাকিবের নিকট রিপার বিষয়ে জানতে চায়। এই নিয়ে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হলে চম্পা নিহত রাকিবের গলায় গামছা পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করে। হত্যার পর আসামী নওশাদ তার গুরুমা রুমি হিজড়ার বাসা থেকে চটের বস্তা নিয়ে এসে উক্ত বস্তায় রাকিবের লাশটি ভরে পাশের রুমে রেখে গুম করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। ৫ দিন পর ৬ষ্ঠ দিনের মাথায় প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে সন্ধার পরে এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় সে বস্তায় ভরে রাখা লাশটি নিয়ে এসে রাতের অন্ধকারে বাসার পাশে ঝোপের মধ্যে (ঘটনাস্থলে) ফেলে রেখে সে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকে। পরের দিন সকালে স্থানীয়রা বস্তাবন্দি লাশ দেখতে পেয়ে থানা পুলিশকে খবর দিলে চম্পা পালিয়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানা এলাকার হিজড়া পল্লিতে গিয়ে নাম পরিবর্তন করে স্বপ্না হিজড়া নামে আত্মগোপণ করে।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মোঃ কুদরত-ই- খুদা জানান, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আসামী নওশাদ ওরফে চম্পা হিজড়াকে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হলে সে ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে বিজ্ঞ আদালতে অপরাধ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।