পণ্য সরবরাহ ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে বিশেষ কমিশন গঠনের প্রস্তাব
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে একটি সমন্বিত খাদ্য সরবরাহ চেইন উন্নয়ন ও পরিবীক্ষণ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর একটি হোটেলে বণিক বার্তা আয়োজিত ‘খাদ্যপণ্যের যৌক্তিক দাম: বাজার তত্ত্বাবধানের কৌশল অনুসন্ধান’ শীর্ষক নীতি সম্মেলনে তিনি এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।


তিনি বলেন, এই কমিশন বর্তমানে প্রচলিত সংস্কার কমিশন নয়, বরং এটি স্থায়ীভাবে বাজার তদারকির জন্য গঠন করতে হবে, যা অন্যান্য দেশেও প্রচলিত রয়েছে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, খুচরা বাজারকে কেন্দ্র করে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলেও প্রকৃত সমস্যা অন্য স্তরে রয়ে গেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ব্যবসায়ীদের তথ্য-উপাত্ত সরকারের জানা থাকা উচিত এবং তাদের লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান বাজার কাঠামোতে একজন ব্যবসায়ী যত বড় হতে চান, হতে পারেন, এতে কোনো বিধিনিষেধ নেই। বাজারে প্রভাব বিস্তার রোধে আইনি সংস্কার প্রয়োজন। প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে বাধ্যতামূলক লাইসেন্স নিতে হবে, এবং কোনো পরিবেশক যাতে শুধুমাত্র একক ব্র্যান্ডের পণ্য সরবরাহ করতে না পারে, সেটিও নিশ্চিত করা দরকার।”
তিনি জানান, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের অভাব। “বার্ষিক উৎপাদন ও সরবরাহের তথ্য থাকলেও দৈনিক ভিত্তিতে তথ্য সরকারের কাছে থাকে না, যা ব্যবসায়ীদের কাছে বিদ্যমান থাকে। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণ কার্যকরভাবে সম্ভব হয় না,” বলেন তিনি।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, “সরকারকে ফুড মার্কেট স্থাপন করতে হবে, যেখানে শুধুমাত্র নিবন্ধিত এজেন্টরা কাজ করবে। এর মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।”
অনুষ্ঠানে আলোচকরা জানান, বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তা কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ালে গণমাধ্যমে চাপ তৈরি হয়, এরপর সরকার তাৎক্ষণিকভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়। ব্যবসায়ীদের চাপে সরকার আবার শুল্ক বা কর হ্রাস করে, যার ফলে বাজারে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান আসে না। এই নীতিগত দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে।”
বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন এএইচএম আহসান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খান, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ ফয়সল আজাদ।
এসিআই লজিস্টিকস লিমিটেডের (স্বপ্ন) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির বলেন, “রোজার সময় সয়াবিন তেল ও চাল নিয়ে সরকারকে আগেভাগে ভাবতে হবে। ব্রাজিল থেকে চিনি আমদানির পরিমাণ বেড়েছে, এবং ছোলার সংকট হওয়ার আশঙ্কা নেই।”
তিনি আরও বলেন, “সয়াবিন তেলে মুনাফা কম বলে ধারণা করা হয়। আমরা রিফাইনারিদের সঙ্গে কথা বলেছি, কিন্তু তাদের নিয়ে সিন্ডিকেটের কল্পনার জগৎ থেকে আমাদের বের হতে হবে।”
কাওরান বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফরিদ আহমেদ রাসেল বলেন, “যদি পণ্যের মূল্য নির্ধারণের রসিদ বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে বাজারে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।”
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, “শুল্ক হ্রাস করা হলেও বাজারে এর প্রভাব পড়ে না, অথচ ভ্যাট বাড়ানোর সাথে সাথে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়। বিশ্ববাজারে গমের দাম কমলেও দেশে তা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।”
বাজারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং কার্যকর তদারকি নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন। পাশাপাশি তথ্যভিত্তিক নীতিগত সংস্কার ও বাজারের সঠিক কাঠামো তৈরি করতে সরকারের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের পরামর্শ দেন তারা।