একজন চারণ চিকিৎসক ডা. জাফরুল্লাহর কথা: ডা. নাজমুল ইসলাম

ডা. নাজমুল ইসলামডা. নাজমুল ইসলাম
প্রকাশিত: ৪:৩৮ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৩, ২০২৩

হুমায়ন মোর্শেদ চৌধুরী এবং শিরিন বেগম চৌধুরী দম্পতি ১৯৩৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জনাব হুমায়ন কর্ম সংস্থানের খোঁজে বিয়ের পর পাড়ি জমান কলকাতাতে। চাকরি নেন জাহাজের টিকিট চেকার হিসেবে। জাহাজের চাকরি ভালোই উপভোগ করছিলেন।

কারণ তাতে বিভিন্ন জায়গা ঘুরার অবারিত সুযোগ মিলছে হুমায়ন সাহেবের। ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে সুবিদিত ছিলেন হুমায়ন চৌধুরী। সেই সুবাদে ব্রিটিশদের সুনজরে পড়েন। পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি মিলে ক্যালকাটা মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভাগে।

বিয়ের ৯ বছর হয়ে গেলেও তারা কোনো সন্তানের মুখ দেখতে পান না। তখনকার সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশি দিন সন্তানাদি না-হওয়া বিশেষ ভালো নজরে দেখা হতো না। এ ধরনের ঘটনায় তখনকার দিনে সংসারে প্রচুর অশান্তির সৃষ্টি হতো। আর সবচেয়ে কুৎসিত ব্যাপার হচ্ছে এর জন্য দায়ি করা হতো স্ত্রীকে। হুমায়ন চৌধুরীর পরিবার অবশ্য এ রকম ছিলেন না।

হুমায়ন সাহেবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এয়াকুব আলী চৌধুরীর মা একবার শিরিন বেগম চৌধুরীকে দেখতে আসেন তাদের কলকাতার বাসায়। এয়াকুব সাহেবের মা শিরিন বেগমকে দেখে বললেন-আল্লাহ তোমাকে এমন এক পুত্র সন্তান দেবেন যে নামে যশে সারা পৃথিবীতে পরিচিত হবে।

হুমায়ন-শিরিন দম্পতি প্রথম সন্তান লাভ করেন ১৯৪১ সালে। দিনটি ছিল ২৭ ডিসেম্বর। সন্তানের নাম রাখেন এ টি এম জাফরুল্লাহ চৌধুরী। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জন্ম নেয়া এই শিশু সত্যি সত্যিই সুখ্যাতি অর্জন করেন তার কর্মের মধ্যে দিয়ে।

কারো কাছে তিনি জাতীয় ওষুধ নীতির প্রবক্তা, কারো কাছে স্বাস্থ্য নীতির প্রবক্তা আবার কারো কাছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। গরীবের স্বাস্থ্যসেবায় তার অবদান অতুলনীয়। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নামেই তিনি সমাধিক পরিচিত।

Nagad

ডা.চৌধুরীর ১০ ভাই-বোন। শৈশবকালের কিছু সময় বেড়ে উঠেন কলকাতায় এবং পরবর্তীতে পরিবারসহ ঢাকায় ফিরে আসেন।

পিতার ভাষায়- জাফরুল্লাহ ছোটকাল থেকেই মানুষজনের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় তার সঙ্গী ছাত্র বই কিনতে কিংবা স্কুলের বেতন দিতে অসমর্থ হলে, সে ছোটদের টিউশনি করিয়ে যে টাকা পেতো তা দিয়ে সাহায্য করতো।

ঢাকার বকশিবাজারের নবকুমার স্কুলের মধ্যে দিয়ে শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়া অবস্থায় বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র ইউনিয়নে’ যোগদান করেন।

বামপন্থী ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। ছাত্র সংসদের জিএস হিসেবে ছাত্রদের বিভিন্ন ন্যায্য দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন।

ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের মেডিকেল কলেজগুলোতে পরীক্ষার নামে প্রায়ই ছাত্রদেরকে নানা অজুহাতে নাজেহাল করা হতো। এসব পরীক্ষায় ছাত্রদের উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য মেধা বা জ্ঞানের চেয়ে বিভাগীয় প্রধানদের খেয়াল-খুশিই প্রাধান্য পেয়ে আসছিল।

জাফরুল্লাহ এসব অনাচারের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। যার কারণে তিনি স্বৈরাচার আইয়ুব- মোনায়েমের বিরাগভাজন হন। এক পর্যায়ে জাফরুল্লাহকে প্রধান আসামি করে মামলা করা হয়। দীর্ঘদিন মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। সবশেষ জেলেও যেতেও হয় ।

এতসব মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে ১৯৬৪ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। জাফরুল্লাহর ইচ্ছা ছিল শল্য চিকিৎসক হওয়ার। পাশ করার পর স্বনামধন্য শল্য চিকিৎসকদের সহকারী হিসেবে ট্রেনিং নেন। আইয়ুব-মোনায়েমের চক্ষুশূল হওয়ার কারণে বুঝতে পারেন দেশে ভালো কোন ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব না। তাই বিদেশ যাওয়ার মনস্থির করেন। ১৯৬৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য জাফরুল্লাহ বিলেত গমন করেন।

বিলেত গমনও বেশ সহজ ব্যাপার ছিল না । তখন নিয়ম ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোন ছাত্র দেশের বাইরে যেতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাকে এনওসি বা অনাপত্তিপত্র নিতে হতো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা সব দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের শোষণ করতো।

স্কলারশিপ বা উচ্চশিক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাউকে মনোনয়ন করা হতো না। অনেক কষ্টে জাফরুল্লাহ বন্ধু মসিহউজ্জামানের বাবা ইন্সপেক্টর আখতারুজ্জামানের মাধ্যমে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করেন। অনেক গোপনীয়তায় নভেম্বর মাসের ৯ তারিখ ঢাকা ত্যাগ করেন জাফরুল্লাহ।

কিন্তু ফ্লাইটটি সরাসরি লন্ডনগামী ছিলনা। ঢাকা থেকে করাচি তারপর লন্ডন। ফলে করাচিতে বিরতির জন্য সবাই উদ্বিগ্ন ছিলো। জাফরুল্লাহর বিলেত যাওয়ার কারণে বাবা হুমায়ন মোর্শেদ চৌধুরীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে পাকিস্তান সরকার। পুলিশ কর্মকর্তা হুমায়ন বেশ কড়া ভাষায় প্রশাসনকে জবাব দেন।

পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্লাস্টিক সার্জন হবার চেয়ে প্রথম ভাস্কুলার সার্জন হওয়াকেই বেছে নেন জাফরুল্লাহ। প্রাথমিক পরীক্ষাতে তিনি কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। দ্রুততার সাথেই এগিয়ে চলছিল লেখাপড়া। ফাইনাল পরীক্ষা দিবেন এমন সময়ে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অংশ নিতে লন্ডন থেকে ভারতে আসেন ড. জাফরুল্লাহ। কলকাতা এসে তিনি প্রচুর আহত মুক্তিযোদ্ধা দেখতে পান। এসব আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য তিনি একটি হাসপাতাল তৈরির প্রয়াস নেন।

জুলাই-আগস্ট মাসে প্রবাসী সরকার, পূর্ব সীমান্তের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফের সক্রিয় সহযোগিতায় জাফরুল্লাহ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার সুব্যবস্থার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হসপিটাল’ স্থাপন করে।

যুদ্ধফ্রন্টে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে আবার যুদ্ধফ্রন্টে ফেরত পাঠানো না গেলে চিকিৎসার অভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হবে এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক যোদ্ধা পাওয়া কষ্টকর হবে।

তাই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত সেবা প্রদান করে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরত পাঠানো হয়। এভাবে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন জাফরুল্লাহ।

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে জাফরুল্লাহ প্রয়োজনীয় যুদ্ধসামগ্রী সংগ্রহে বহু দেশ সফর করেন। এসব অস্ত্রবল এবং ওষুধপত্র সংগ্রহ করে তিনি প্রয়োজনীয় যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। জুন মাসে জাফরুল্লাহ ঢাকায় আসেন।

ঢাকায় এসে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশের নদীপথের ম্যাপ, শত্রুদের নদীতে চলাচল পথ এবং প্রধানত কোন কোন জাহাজে সামরিক বাহিনীর মালামাল বহন করা হচ্ছে তার পূর্ণ বিবরণ সংগ্রহ করে নিরাপদে যুদ্ধ ফ্রন্টে ফিরে যান।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশে ফিরতে জাফরুল্লাহর কয়েকদিন দেরি হয়। ২৩শে ডিসেম্বর বিকেলে জাফরুল্লাহ ঢাকার বাসায় উপস্থিত হন। তার দেশে ফিরতে দেরি হওয়ার কারণ ছিল ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’-এর আহত মুক্তিযোদ্ধাসহ হাসপাতালের সব জিনিসপত্র সরানো।

সীমান্তপথে হাসপাতালের সব মালামাল কুমিল্লায় আনা হয়। আহত মুক্তিযোদ্ধা ও হাসপাতালের মালামাল দুই মাসের মধ্যে ঢাকায় নিয়ে আসেন জাফরুল্লাহ। ১৯৭২ সালে ঢাকার অদূরে সাভারে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে একটি পাবলিক চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করেন।

সে সময় নাম নিয়েয় আপত্তি আসে প্রশাসনের তরফ থেকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’র নামও চূড়ান্ত করে দেন বঙ্গবন্ধু। কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ দেন প্রায় ৩১ একর জমি।

বি দ্র: লেখক গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ ২০১০-১১ সেশনের শিক্ষার্থী। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বাবা পিতা মরহুম হুমায়ুন মোর্শেদ চৌধুরীর লেখা বই ‘আমাদের কাল আমার কথা’ থেকে তথ্য নিয়েছেন লেখক।

সারাদিন. ১৩ এপ্রিল